Saturday, March 11, 2023

ফেরাউন ও তার কওমের উপর আপতিত আযাব

 ফেরাউন ও তার কওমের উপর আপতিত আযাব


আল্লাহ তা‘আলা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে নয়টি মুজিযা দান করেছিলেন। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ফেরাউনের সম্প্রদায়কে সতর্ক করে সত্য পথে আনা। এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 


وَلَقَدْ اٰتَيْنَا مُوْسٰى تِسْعَ اٰيَاتٍ...


অর্থঃ আমি মুসা ‘আলাইহিস সালামকে নয়টি প্রকাশ্য মুজিযা প্রদান করেছিলাম। (সূরা বনী-ইসরাঈল, আয়াত: ১০১)


اية

 শব্দটি মুজিযার অর্থেও ব্যবহৃত হয়, আসমানি কিতাবের আয়াত বা আহকামে ইলাহীর অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এখানে উভয় অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। বহু তাফসীরবিদ এই স্থলে اية -এর অর্থ মুজিযা নিয়েছেন।


‘নয়’ সংখ্যা উল্লেখ করা হলেও মুসা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিযার সংখ্যা আরো বেশি ছিল, কিন্তু এখানে নয়টি মুজিযার বিশেষ গুরুত্বের কারণে নয় সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে।


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. উক্ত নয়টি মুজিযা এভাবে গণনা করেছেন, ১. মুসা ‘আলাইহিস সালামের লাঠি, যা যমিনে ফেললেই অজগর সাপ হয়ে যেত। ২. মুসা ‘আলাইহিস সালামের শুভ্র হাত, যা বগলের নিচ থেকে বের করতেই উজ্জ্বল হয়ে চমকাতে থাকতো। ৩. মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুখে তোতলামি ছিল, যা অলৌকিকভাবে দূর করে দেওয়া হয়েছিল। ৪. বনী ইসরাইলকে নদী পার করানোর জন্য নদী বিভক্ত করে বারোটি রাস্তা করে দেওয়া হয়েছিল। ৫. ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়ের উপর পঙ্গপালের আযাব এসেছিল। ৬. তাদের প্রতি তুফানের আযাব প্রেরণ করা হয়েছিল। ৭. তাদের শরীরে উঁকুনের আযাব প্রেরণ করা হয়েছিল। ৮. ব্যাঙের আযাব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৯. তাদের উপর রক্তের আযাব প্রেরণ করা হয়েছিল।


এই নয়টি মুজিযার মধ্যে প্রথম দুটি অর্থাৎ লাঠি সাপ হওয়া এবং হাত জ্যোতির্ময় হওয়া ফেরাউনের দরবারে প্রকাশিত হয়। লাঠি সাপ হয়ে যাওয়ার মুজিযার মাধ্যমেই হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম যাদুকরদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। আর ৫নং থেকে ৯নং পর্যন্ত বর্ণিত পাঁচটি মুজিযা ফেরাউন ও তার কওমের উপর আযাব-গজব নাযিল সংক্রান্ত।


ফেরাউনের কওমের উপর দুর্ভিক্ষের আযাব


অবশ্য এই পাঁচটি আযাব ছাড়াও ফেরাউন ও তার কওমের উপর আরো আযাব অবতীর্ণ হয়েছে বলে বর্ণিত আছে। যেমন, ফেরাউন ও তার কওমের উপর দুর্ভিক্ষের আযাব নাযিল হওয়ার বিষয়েও পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

 

وَلَقَدْ اَخَذْنَا آلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِيْنَ وَنَقْصٍ مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ


অর্থঃ আমি পাকড়াও করেছিলাম ফেরাউনের অনুসারীদের দুর্ভিক্ষ ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি দিয়ে, যেন তারা হিদায়াত গ্রহণ করে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৩০)


যখন ফেরাউনের সম্প্রদায়ের হঠকারিতা ও দুরাচরণের ফলে দুর্ভিক্ষের আগমন হয়েছিল, তখন তাদের ক্ষেতের ফসল ও বাগ-বাগিচার উৎপাদন চরমভাবে হ্রাস পায়। যার দরুন তারা অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তারা ঈমান আনার অঙ্গীকার করে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তিলাভের দু‘আ করায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মুসা ‘আলাইহিস সালামের দু‘আয় দুর্ভিক্ষ রহিত হয়ে গেলে, পুনরায় তারা অহংকার প্রদর্শন করে এবং ঈমান আনতে অস্বীকার করে। উপরন্তু তারা বলতে শুরু করে, এই দুর্ভিক্ষ মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গী-সাথীদের কুলক্ষণের দরুনই আপতিত হয়েছিল। আর এখন যে দুর্ভিক্ষ রহিত হয়ে গিয়েছে, তা হলো আমাদের সৎকর্মের স্বাভাবিক ফল। এমনটিই তো আমাদের প্রাপ্য।


তেমনিভাবে তারা যেকোনো ভালো কিছু পেলে তা নিজেদের কৃতিত্ব মনে করতে থাকে এবং মন্দ ও দুর্দশার সম্মুখীন হলে সেটা মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারীদের কারণে হয়েছে বলে চালিয়ে দিতে থাকে। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, 


فَاِذَا جَآءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوْا لَنَا هٰذِه وَاِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوْا بِمُوْسٰى وَمَنْ مَّعَهٗ اَلَا اِنَّمَا طَآئِرُهُمْ عِنْدَ اللّٰهِ وَلَكِنَّ اَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ


অর্থঃ যখন ভালো দিন ফিরে আসে, তখন তারা বলতে আরম্ভ করে, “আমাদের জন্যই তো এটা।” আর যদি কোন অকল্যাণ এসে উপস্থিত হয়, তবে তার জন্য মুসা ‘আলাইহিস সালাম এবং তার সঙ্গীদের অলক্ষুণে মনে করে। শুনে রাখো, তাদের অলক্ষুণের কথা আল্লাহ তা‘আলারই জানা আছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৩১)


বহু প্রচেষ্টার পরও ফেরাউনসম্প্রদায় হিদায়াতের পথে না আসায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর একের পর এক নানান আযাব-গজব নাযিল করেন। এ সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 


فَاَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الطُّوْفَانَ وَالْجَرَادَ وَالْقُمَّلَ وَالضَّفَادِعَ وَالدَّمَ اٰيَاتٍ مُّفَصَّلَاتٍ


অর্থঃ তখন আমি তাদের উপর পাঠালাম তুফান, পঙ্গপাল, উঁকুন, ব্যাঙ ও রক্ত বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৩৩)


এই আয়াতে ফেরাউনের সম্প্রদায়ের উপর আপতিত পাঁচ রকমের আযাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব আযাব اٰيتٍ مُفَصَّلَاتٍ (বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক) বলার তাৎপর্য সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি আযাবই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবস্থান করে। অতঃপর রহিত হয়ে যায়। এরপর কিছুসময় বিরতি দিয়ে পুনরায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় কিংবা তৎপরবর্তী আযাবগুলো পৃথক পৃথকভাবে আসে।


ইবনে মুনযির, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন, এগুলোর প্রতিটি আযাব ফেরাউনগোষ্ঠীর উপর সাতদিন করে স্থায়ী হয়। শনিবার শুরু হয়ে দ্বিতীয় শনিবারে রহিত হয়ে যেত এবং পরবর্তী আযাব আসা পর্যন্ত তিন সপ্তাহর অবকাশ দেওয়া হত।


ইমাম বাগাবী রহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, প্রথমবার যখন ফেরাউনের কওমের উপর দুর্ভিক্ষের আযাব আপতিত হয় এবং হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের দু‘আয় তা রহিত হয়ে যায়। কিন্তু তারা নিজেদের নাফরমানী থেকে বিরত হয় না। তখন হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম প্রার্থনা করেন, হে আমার পালনকর্তা, এরা এতই অহংকারী যে, দুর্ভিক্ষের আযাবে কোনরূপ প্রভাবিত হয়নি। তারা নিজেদের কৃত ঈমান আনার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে। সুতরাং তাদের উপর এমন কোন আযাব চাপিয়ে দিন, যা হবে তাদের জন্য বেদনাদায়ক ও আমাদের জাতির জন্য উপদেশ গ্রহণের উপায় এবং যা পরবর্তীদের জন্য হবে সংশোধনমূলক শিক্ষা। তখন আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে তাদের উপর তুফানের আযাব নাযিল করেন।


প্রখ্যাত মুফাসসিরগণের মতে, এখানে তুফান অর্থ পানির তুফান। অর্থাৎ জলোচ্ছ্বাস। তাতে ফেরাউনের সম্প্রদায়ের সমস্ত ঘর-বাড়ি ও জমি-জমা জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়। না থাকে কোথাও তাদের শোয়া-বসার জায়গা, না থাকে জমি চাষাবাদের কোন ব্যবস্থা।


আশ্চর্যের বিষয় ছিল, ফেরাউন গোত্রের সন্দেহ ছিল বনী ইসরাইলের ঘর-বাড়ি ও জমি-জমা জলোচ্ছাসে ডুবে গেছে অথচ বনী ইসরাইলের ঘর-বাড়ি ও জমি-জমা সবই ছিল শুকনো, স্বাভাবিক। সেগুলোর কোথাও জলোচ্ছ্বাসের কোন পানি ছিল না। কিন্তু ফেরাউন সম্প্রদায়ের জমি ছিল অথৈ পানির নিচে।


এই জলোচ্ছ্বাসে ভীত হয়ে ফেরাউনসম্প্রদায় মুসা ‘আলাইহিস সালামের নিকট আবেদন জানালো, আপনার পালনকর্তার দরবারে দু‘আ করুন, যাতে এই আযাব দূর হয়ে যায়। তা হলে আমরা ঈমান আনবো এবং বনী ইসরাইলকে মুক্ত করে দিবো। তখন হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম দু‘আ করলেন। তার দু‘আর ফলে জলোচ্ছ্বাসের তুফান রহিত হয়ে গিয়ে তাদের শস্য-ফসলক্ষেত্র আগের চেয়েও অধিক সুজলা-সুফলা হয়ে উঠলো।


তখন সেই নাফরমানরা বলতে শুরু করলো, আদতে এই তুফান কোন আযাব ছিল না। বরং আমাদের ফায়দার জন্যই তা এসেছিল। যার ফলে আমাদের শস্যভূমির উৎপাদন-ক্ষমতা বেড়ে গেছে। মুসা ‘আলাইহিস সালামের এতে কোন ভূমিকা নেই। সুতরাং আমরা ঈমান আনবো না। এসব কথা বলে তারা ঈমান আনার ব্যাপারে কৃত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলো।


এমতাবস্থায় তারা মাসাধিকাল সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। মেহেরবান আল্লাহ তাদের চিন্তা-ভাবনার জন্য অবকাশ দান করেন। কিন্তু তাদের চৈতন্যের উদয় হলো না। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর পঙ্গপালের আযাব নাযিল করলেন। এই পঙ্গপাল তাদের সমস্ত শস্য-ফসল ও বাগানের ফল-ফলাদি খেয়ে নিঃশেষ করে ফেললো। কোন কোন রেওয়ায়াতে এসেছে, কাঠের দরজা-জানালা, ছাদ প্রভৃতিসহ ঘরের ব্যবহার্য্য আসবাবপত্র পঙ্গপাল খেয়ে শেষ করে ফেলেছিল।




আযাব যেভাবে ফেরাউনের কওমকে ধ্বংস করলো


ক্রমাগত এতবার পরীক্ষা ও অবকাশ দানের পরেও যখন ফেরাউনের সম্প্রদায়ের মধ্যে বোধোদয়ের সৃষ্টি হয়নি, তখন তাদের উপর আবর্তিত হয় চূড়ান্ত ও সর্বশেষ আযাব এবং তাতে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। তা এভাবে আসে যে, আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে মুসা ‘আলাইহিস সালামও তার সম্প্রদায় ফেরাউন ও তার জাতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সেদেশ ছেড়ে রওয়ানা হন। তখন ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নিজেদের ঘর-বাড়ি, জমি-জমা ও আসবাবপত্র সবকিছু রেখে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও বনী ইসরাইলের অনুসরণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।


এ সম্বন্ধে তাফসিরে রুহুল মাআনীতে বর্ণিত আছে, হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে রাতের সূচনাভাগে বনী ইসরাইলকে নিয়ে মিসর থেকে লোহিত সাগরের দিকে অর্থাৎ মিসরের পূর্বস্থ এলাকা শামদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।


বনী ইসরাইলের সংখ্যা তখন ছয় লাখ তিন হাজার এবং অন্য রেওয়ায়েত অনুযায়ী ছয় লাখ সত্তর হাজার ছিল। এগুলো ইসরাইলী রেওয়ায়েত বিধায় অতিরঞ্জিত হতে পারে। তবে কুরআনে কারিম ও হাদীস থেকে এতটুকু তথ্য প্রমাণিত যে, তাদের বারটি গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের জনসংখ্যা ছিল বিপুল।


বস্তুত হযরত ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের আমলে বনী ইসরাইল যখন মিসরে আগমন করে, তখন তারা বারো ভাই ছিল। সেই বারো ভাইয়ের বারো গোত্রের এতো বিপুলসংখ্যক লোক মিসর থেকে বের হলো, তাদের সংখ্যা ছয় লাখেরও অধিক বর্ণনা করা হয়।


ফেরাউন তাদের মিসর ত্যাগের সংবাদ সম্বন্ধে অবগত হয়ে নিজ সৈন্যবাহিনীকে একত্র করলো এবং মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায়কে পাকড়াও করার জন্য ধাওয়া করলো। ফেরাউনের সাথে সত্তর হাজার কৃষ্ণবর্ণের ঘোড়া ছিল এবং অগ্রবর্তী বাহিনীতে সাত লাখ সওয়ার ছিল।


পিছন দিকে ফেরাউন ও তার সেনাবহর এবং সামনে লোহিতসাগর দেখে বনী ইসরাইল ঘাবড়ে গেল। তাই তারা মুসা ‘আলাইহিস সালামকে বললো,


 اِنَّا لَمُدْرَكُونَ “


“আমরা ধরা পড়ে গেলাম”। (সূরা শুআরা, আয়াত: ৬১)


তখন মুসা ‘আলাইহিস সালাম তাদের সান্তনা দিয়ে বললেন,


 اِنَّ مَعِىَ رَبِّىْ سَيَهْدِيْنِ ○ “


“আমার সাথে আমার পালনকর্তা আছেন। তিনি আমাকে পথ দেখাবেন”। (সূরা শুআরা, আয়াত: ৬২)


এরপর মুসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে সমুদ্রে লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন। ফলে সঙ্গে সঙ্গে তাতে বারোটি রাস্তা নির্মিত হয়ে গেল এবং সাগরের পানি প্রাচীরের মতো দণ্ডায়মান হয়ে থাকলো। তখন বনী ইসরাইলের বারোটি গোত্র এসব সড়ক দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে গেল। কুরআনুল কারীমে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, 


فَاَوْحَیْنَاۤ اِلٰی مُوْسٰۤی اَنِ اضْرِبْ بِّعَصَاکَ الْبَحْرَؕ فَانْفَلَقَ فَکَانَ كُلُّ فِرْقٍ کَالطَّوْدِ الْعَظِیْمِ ○ وَ اَزْلَفْنَا ثَمَّ الْاٰخَرِیْنَ ○ وَ اَنْجَیْنَا مُوْسٰی وَ مَنْ مَّعَهٗۤ اَجْمَعِیْنَ○


অর্থঃ অতঃপর আমি মুসা ‘আলাইহিস সালামকে আদেশ করলাম, আপনি নিজের লাঠি দিয়ে সমুদ্রে আঘাত করুন। ফলে সঙ্গে সঙ্গে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতসদৃশ্য হয়ে গেল। আর সেখানে অপর দলকে (ফেরাউনের বাহিনী) পৌঁছে দিলাম। আর আমি হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম। (সূরা শুআরা, আয়াত: ৬৩-৬৫)


ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী সমুদ্রের কাছে পৌঁছে এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। সমুদ্রের বুকে এই রাস্তা কীভাবে তৈরি হলো? কিন্তু এর পরেও ফেরাউন তার সৈনিকদের সগর্বে বললো, এগুলো আমার প্রতাপের লীলা। এর কারণে সমুদ্রের স্রোত বন্ধ হয়ে রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এ কথা বলে সে সামনে অগ্রসর হয়ে নিজের ঘোড়া সমুদ্রের পথে চালিয়ে দিলো এবং গোটা সৈন্যবাহিনীকে তার পেছনে পেছনে আসার জন্য আদেশ দিলো।


যখন ফেরাউন তার সৈন্যবাহিনীসহ সমুদ্রপথের মাঝখানে এসে গেল এবং একটি লোকও তীরে বাকি রইলো না। অপরদিকে বনী ইসরাইল সমুদ্রের অপর তীরে পৌঁছে গেল। তখন আল্লাহ তা‘আলা সমুদ্রকে রাস্তা বিলীন করে আগের মতো প্রবাহিত হওয়ার হুকুম দিলেন। সমুদ্রের সকল অংশ পরস্পর মিলে গেল। ফলে ফেরাউন ও তার দলবল লোহিতসাগরের মধ্যে পড়ে অথৈ পানি ও স্রোতের গ্রাসে পরিণত হলো। এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 


فَاَغْرَقْنَاهُمْ فِى الْيَمِّ بِاَنَّهُمْ كَذَّبُوْا بِاٰيَاتِنَا وَكَانُوْا عَنْهَا غَافِلِيْنَ○ وَاَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِيْنَ كَانُوْا يُسْتَضْعَفُوْنَ مَشَارِقَ الْاَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِىْ بَارَكْنَا فِيْهَا


অর্থঃ তখন আমি তাদের সাগরের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম। কারণ, তারা মিথ্যাপ্রতিপন্ন করেছিল আমার নিদর্শনসমূহ এবং এ সম্পর্কে তারা উদাসীন ছিল। আর আমি উত্তরাধিকারী করে দিলাম সেই কওমকে, যাদের দুর্বল মনে করা হতো সেই যমিনের পূর্ব ও পশ্চিমের অংশসমূহের, যাতে আমি বরকত স্থাপন করেছিলাম। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৩৬-১৩৭)


অতঃপর ফেরাউন যখন সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে আরম্ভ করলো, তখন সে বলে উঠলো, আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর উপর, যার উপর বনী ইসরাইল ঈমান এনেছে। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, 


حَتّٰۤی اِذَاۤ اَدْرَکَهُ الْغَرَقُ ۙ قَالَ اٰمَنْتُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا الَّذِیْۤ اٰمَنَتْ بِهٖ بَنُوْۤا اِسْرَآءِیْلَ وَ اَنَا مِنَ الْمُسْلِمِیْنَ○


অর্থঃ এমনকি যখন সে (ফেরাউন) নিমজ্জিত থেকে লাগলো, তখন বললো, আমি ঈমান আনলাম, কোন ইলাহ নেই তিনি ছাড়া, যার প্রতি ঈমান এনেছে বনী ইসরাইল। আমি তারই অনুগতদের দলে। (সূরা ইউনুস, আয়াত: ৯০)


তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরাউনের ঈমান আনার ঘোষণার উত্তরে বলেন, 


آٰلْـٰٔنَ وَقَدْ عَصَیْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِیْنَ


অর্থঃ এতক্ষণে ঈমান এনেছ? অথচ এ যাবত নাফরমানী করে চলেছো এবং ফাসাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত থেকেছ! (কিন্তু এখন যে ঈমান আনার এবং ইসলাম গ্রহণের সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে।) (সূরা ইউনুস, আয়াত: ৯১)


এতে প্রমাণিত হয়, ঠিক মৃত্যুকালে যখন প্রাণ হলোকুমে চলে আসে, সেসময় ঈমান আনা শরী‘আত অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টির আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ সেই হাদীসের দিয়েও প্রতীয়মান হয়, যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবা ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করেন, যতক্ষণ না তার মৃত্যুর ঊর্ধ্বশ্বাস আরম্ভ হয়ে যায়। (তিরমিযী্

মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুজিযা

 মুসা ‘আলাইহিস সালানমের মুজিযা


ফেরাউন উল্লিখিত পন্থায় তার উদ্দেশ্য সাধন করতে ব্যর্থ হয়ে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে প্রমাণ পেশ করার দাবি জানিয়ে বললো,


قَالَ اِنْ كُنْتَ جِئْتَ بِاٰيَةٍ فَاْتِ بِهَا اِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ○


অর্থঃ বাস্তবিকই যদি তুমি কোন প্রমাণ নিয়ে এসে থাকো তবে তা উপস্থাপন করো, যদি তুমি সত্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকো। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৬)


তখন হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম তার দাবি মেনে নিয়ে স্বীয় লাঠিখানা মাটিতে ফেলে দিলেন। আর অমনি তা এক বিরাট অজগর সাপে পরিণত হয়ে গেল। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, 


فَاَلْقٰى عَصَاهُ فَاِذَا هِىَ ثُعْبَانٌ مُّبِيْنٌ○


অর্থঃ তখন তিনি তার লাঠিখানা নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জলজ্যান্ত এক অজগর হয়ে গেল। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৭) 


অতঃপর হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম ফেরাউনকে দ্বিতীয় মুজিযা দেখানোর উদ্দেশ্যে নিজের হাতকে বগল থেকে বের করলেন। অমনি তা শুভ্র উজ্জ্বল রূপ ধারণ করলো। নিচের আয়াতে তার এই মুজিযার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে, 


وَنَزَعَ يَدَهٗ فَاِذَا هِىَ بَيْضَاءُ لِلنَّاظِرِيْنَ○


অর্থঃ আর তিনি তার হাত বের করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তা দর্শকদের চোখে ধবধবে উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হলো। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৮)


মুসা ‘আলাইহিস সালামের নবুওয়্যাতের পক্ষে ফেরাউনের প্রমাণ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মুসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে দুটি মুজিযা দেখান। প্রথম মুজিযার বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে, 


فَاَلْقٰى عَصَاهُ فَاِذَا هِىَ ثُعْبَانٌ مُّبِيْنٌ○


অর্থঃ তখন তিনি নিজের লাঠিখানা নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জ্যান্ত এক অজগর হয়ে গেল। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৭)

ثُعْبَانٌ

বলা হয় বিরাটকায় অজগরকে। সেই সঙ্গে গুণবাচক শব্দ مُّبِيْنٌ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেই লাঠির সাপ হয়ে যাওয়াটা এমন কোন গোপন ঘটনা ছিল না, যা অন্ধকারে কিংবা পর্দার আড়ালে ঘটেছিল বা যা কেউ কেউ দেখেছিল আর কেউ কেউ দেখেনি। যেমনটা সাধারণত যাদু বা ভেল্কিবাজির বেলায় হয়ে থাকে। বরং সেই ঘটনা এমন প্রকাশ্য স্থানে সাধারণ মানুষের সামনে ঘটেছিল, যা সকলের চোখের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এটাই প্রমাণ যে, সেটা কোন চোখের ধাঁধা নয়, বরং বাস্তবভাবে সংঘটিত ঘটনা ছিল।


কোন কোন ঐতিহাসিকের উদ্ধৃতিতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, সেই অজগর ফেরাউনের প্রতি যখন হা করে মুখ বাড়ালো, তখন সে সিংহাসন থেকে লাফিয়ে পড়ে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের শরণাপন্ন হলো। আর দরবারের বহুলোক ভয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলো। (তাফসীরে কাবীর)


লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া প্রকৃতিবিরুদ্ধ হওয়ায়, এটা যে বেশ বিস্ময়কর ব্যাপার, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর মুজিযা বা কারামতের উদ্দেশ্যও থাকে তা-ই। যে কাজ সাধারণ মানুষ করতে পারে না, তা নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে করে দেওয়া হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে, তাদের সঙ্গে খোদায়ী শক্তি বিদ্যমান আছে।


তবে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া বিস্ময়কর হলেও অস্বীকার করার মতো কোন বিষয় ছিল না। কেননা, এটা প্রত্যক্ষকারীদের দিয়ে চাক্ষুষভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় দ্বিতীয় যে মুজিযা পেশ করেন, তা হচ্ছে,


وَنَزَعَ يَدَهٗ فَاِذَا هِىَ بَيْضَاءُ لِلنَّاظِرِيْنَ○


অর্থঃ আর তিনি নিজের হাত বের করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তা দর্শকদের চোখে ধবধবে উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হলো। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৮)

نَزَعَ 

এর মূলধাতু نَزْعٌ -এর অর্থ হলো একটি বস্তুকে অপর একটি বস্তুর ভেতর থেকে কিছুটা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বের করা। সুতরাং এখানে উদ্দেশ্য হলো মুসা ‘আলাইহিস সালাম নিজের হাতখানা টেনে বের করলেন।


মুসা ‘আলাইহিস সালাম হাতখানা কিসের ভেতর থেকে বের করলেন, তা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু কুরআনে কারীমের অন্যত্র বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, 


وَاضْمُمْ يَدَكَ اِلٰى جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَيْضَاءَ مِنْ غَيْرِ سُوْءٍ اٰيَةً اُخْرٰى○


অর্থঃ আর আপনি আপনার হাত বগলে রাখুন। (এরপর তা বের করলে) তা বের হয়ে আসবে নির্মল উজ্জ্বল অবস্থায়। এটা অন্য এক নিদর্শনরূপে প্রদান করা হলো। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ২২)


বস্তুত মুসা ‘আলাইহিস সালাম উক্ত হাত তার বগলের নিচে দাবিয়ে সেখান থেকে বের করে আনলে এই মুজিযা প্রকাশ পেত অর্থাৎ তখন তা দর্শকদের সামনে সূর্যের মতো ঝলমল করতে থাকতো। (তাফসীরে মাযহারী)


বলাবাহুল্য, ফেরাউনের দাবিতে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম দু’টি মুজিযা প্রদর্শন করেছিলেন। একটি হলো লাঠির সাপ হয়ে যাওয়া। অপরটি হলো নিজের হাত মোবারক বগলের নিচে দাবিয়ে বের করে আনলে তা প্রদীপ্ত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠা। প্রথম মুজিযাটি ছিল বিরোধীদের ভীতিপ্রদর্শন করার জন্য আর দ্বিতীয়টি তাদের আকৃষ্ট করে কাছে আনার উদ্দেশ্যে। এতে এই ইংগিত ছিল যে, হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের শিক্ষায় একটি হিদায়াতের জ্যোতি রয়েছে। তাই তার অনুসরণ-অনুকরণই কল্যাণ ও কামিয়াবীর একমাত্র চাবিকাঠি।




মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুজিযা ও ফেরাউনের যাদু


হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের এই দুটি মুজিযা দেখার পরে ফেরাউনের সাঙ্গপাঙ্গরা যে মন্তব্য করলো, নিচের আয়াতে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


قَالَ الْمَلَاُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ اِنَّ هٰذَا لَسَاحِرٌ عَلِيْمٌ○


অর্থঃ ফেরাউনের কওমের সরদাররা বলতে লাগলো, নিশ্চয় এ একজন বিজ্ঞ যাদুকর। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৯)


তারা মুজিযার বিস্ময়কর ঘটনা দেখার পর একে যাদু বলে আখ্যায়িত করলো। কিন্তু তারাও এখানে ساحر শব্দের সাথে عليم শব্দটি যোগ করে একথা স্বীকার করলো, হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুজিযা সম্পর্কে তাদের মনে এই অনুভূতি জন্মেছে যে, এ কাজটি সাধারণ যাদুকরদের কাজ থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন প্রকৃতির। সেজন্যই তারা বললো, তিনি বড়ই বিজ্ঞ যাদুকর। সাধারণ যাদুকররা এ ধরনের কাজ দেখাতে পারে না।


হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম থেকে উল্লিখিত মুজিযা প্রকাশ পাওয়ার পরে ফেরাউনের কওমের সরদাররা আরো বলতে লাগলো, মুসা যেহেতু একজন বিজ্ঞ যাদুকর, তাই সে তোমাদের দেশান্তর করে দেশ দখল করে নিবে। পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে তাদের উক্ত কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


يُرِيْدُ اَنْ يُّخْرِجَكُمْ مِّنْ اَرْضِكُمْ فَمَاذَا تَاْمُرُوْنَ○


অর্থঃ (তারা বললো,) সে তোমাদের দেশ থেকে তোমাদের বের করে দিতে চায়। এ ব্যাপারে তোমাদের কী মত? (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১০)


ফেরাউনের সম্প্রদায় একথা শুনে উত্তর দিলো, 


اَرْجِهْ وَاَخَاهُ وَاَرْسِلْ فِى الْمَدَائِنِ حَاشِرِيْنَ، يَاْتُوْكَ بِكُلِّ سَاحِرٍ عَلِيْمٍ○


অর্থঃ আপনি তাকে ও তার ভাইকে কিঞ্চিৎ অবকাশ দিন এবং শহরে-বন্দরে লোক প্রেরণ করুন যাদুকরদের সমবেত করার জন্য। তারা আপনার নিকট বিজ্ঞ যাদুকরদের সমাবেশ ঘটাবে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১১)


অর্থাৎ, সম্প্রদায়ের লোকেরা পরামর্শ দিলো, তিনি যদি যাদুকর হয়ে থাকেন এবং যাদু দিয়েই আমাদের দেশ দখল করতে চান, তবে তার মোকাবেলা করা আমাদের জন্য কোন কঠিন ব্যাপার নয়। কারণ, আমাদের দেশে বড় বড় অভিজ্ঞ যাদুকর রয়েছেন, যারা তাকে যাদুর মাধ্যমে পরাভূত করে দিবেন। কাজেই আপনি কিছু সৈন্য-সামন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিন, তারা গোটা শহর থেকে ভালো যাদুকরদের খুঁজে ডেকে নিয়ে আসবে।


তখন যাদু-মন্ত্রের ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং সাধারণ লোকদের উপর যাদুকরদের প্রচুর প্রভাব ছিল। আর হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকেও লাঠি এবং উজ্জ্বল হাতের মুজিযা এজন্যই দেওয়া হয়েছিল, যাতে তৎকালীন যাদুকরদের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এবং মুজিযার মোকাবেলায় যাদুর পরাজয় সবাই দেখে নিতে পারে।


আর আল্লাহ তা‘আলার নিয়মও তাই যে, প্রত্যেক যুগের নবী-রাসূলকে তিনি সে-যুগের জনগণের সাধারণ প্রবণতা অনুযায়ী মুজিযা দান করেছেন। হযরত ঈসা ‘আলাইহিস সালামের যুগে গ্রিকবিজ্ঞান ও গ্রিকচিকিৎসা বিজ্ঞান যেহেতু উৎকর্ষের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে ছিল, তাই তাকে মুজিযা দেওয়া হয়েছিল জন্মান্ধকে দৃষ্টিসম্পন্ন করে দেওয়া এবং কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করে তোলা। তেমনি মুসা ‘আলাইহিস সালামকে সেই যুগেরই অনুকূল মুজিযা দিয়েছিলেন।


ফেরাউন তার পরিষদবর্গের পরামর্শ অনুযায়ী হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদ্দেশ্যে সারাদেশ থেকে বিজ্ঞ যাদুকরদের সমবেত করলো। তারা যে সমস্ত যাদুকরকে একত্র করেছিল, তাদের সংখ্যার ব্যাপারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক-বর্ণনা রয়েছে। তাদের সংখ্যা বর্ণনাভেদে নয়শ থেকে শুরু করে তিন লক্ষ পর্যন্ত বর্ণিত রয়েছে। তাদের সাথে লাঠি ও দড়ির এক বিরাট স্তূপও ছিল, যা তিনশ উটের পিঠে বোঝাই করে আনা হয়েছিল। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন)  


ফেরাউনের যাদুকররা প্রথমে এসেই দরকষাকষি করতে শুরু করলো, আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এবং তাতে জয়ী হলে, আমরা কী পাবো? এমনটি করার কারণ হচ্ছে, যারা দুনিয়াপন্থী, পার্থিব লাভই হলো তাদের মুখ্য। কাজেই যেকোনো কাজ করার আগে তাদের সামনে থাকে বিনিময় কিংবা লাভের প্রশ্ন। কুরআনে কারীমের নিম্নোক্ত আয়াতে তাদের এই দরকষাকষির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


وَجَاءَ السَّحَرَةُ فِرْعَوْنَ قَالْوْا اِنَّ لَنَا لَاَجْرًا اِنْ كُنَّا نَحْنُ الْغَالِبِيْنَ○


অর্থঃ যাদুকররা ফেরাউনের কাছে এসে উপস্থিত হলো। তারা বললো, আমাদের জন্য কোন পারিশ্রমিক আছে কি, যদি আমরা জয় লাভ করি? (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৩)


পক্ষান্তরে নবী-রাসূল এবং যারা তাদের নায়েব তথা হক্কানী আলেম, তারা প্রতিপদক্ষেপে ঘোষণা করেন, 


وَمَا اَسْئَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ اَجْرٍ، اِنْ اَجْرِىَ اِلَّا عَلٰى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ○


অর্থঃ আমরা যে সত্যের বাণী আপনাদের নিকট পৌঁছে দিই, আপনাদের কাছে তার কোন প্রতিদান আশা করি না। বরং আমাদের প্রতিদানের বিষয় শুধু আল্লাহ তা‘আলার উপরই ন্যস্ত রয়েছে। (সূরা শুআরা, আয়াত: ১৪৫)


যাদুকরদের পারিশ্রমিক দাবির জবাবে ফেরাউন তাদের বললো, তোমরা পারিশ্রমিক চাচ্ছো? আমি তোমাদের পারিশ্রমিক তো দিবই, উপরন্তু তোমাদের শাহী-দরবারের ঘনিষ্ঠদেরও অন্তর্ভুক্ত করে নিবো (যা পারিশ্রমিক থেকে হাজারগুণ মূল্যবান)। কুরআনে কারীমের এক আয়াতে এ কথা তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


قَالَ نَعَمْ وَاِنَّكُمْ لَمِنَ الْمُقَرَّبِيْنَ○


অর্থঃ সে (ফেরাউন) বললো, হ্যাঁ, এবং অবশ্যই তোমরা আমার নিকটবর্তী লোক হয়ে যাবে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৪)


ফেরাউনের সাথে এসব কথাবার্তা বলে নেওয়ার পর যাদুকররা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্থান ও সময় সাব্যস্ত করিয়ে নিলো। এক বিস্তৃত ময়দানে এবং এক উৎসবের দিনে সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় নির্দিষ্ট হলো। এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 


قَالَ مَوْعِدُكُمْ يَوْمُ الزِّينَةِ وَاَن يُحْشَرَ النَّاسُ ضُحًى○


অর্থঃ হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম বললেন, তোমাদের নির্ধারিত সময় তোমাদের উৎসবের দিন এবং লোকজন যেন পূর্বাহ্নেই সমবেত হয়। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৫৯)


কোন কোন রেওয়ায়াতে বর্ণিত আছে, এ সময় যাদুকরদের সরদারের সাথে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম আলোচনা করলেন, আমি যদি তোমাদের উপর বিজয় লাভ করি, তবে তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে তো? তারা বললো, আমাদের কাছে এমন মহাযাদু রয়েছে, যার উপর কেউ জয়ী হতে পারে না। কাজেই আমাদের পরাজয়ের প্রশ্ন উঠতে পারে না। তথাপি যদি আপনি জয়ী হয়ে যান, তা হলে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে ফেরাউনের চোখের সামনে আমরা আপনার প্রতি ঈমান গ্রহণ করবো। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন লিল কুরতুবী)


অতঃপর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দানে যখন সবাই সমবেত হলো তখন যাদুকররা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে উদ্দেশ্য করে যা বলেছিল, এক আয়াতে সে কথাই বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


قَالُوْا يَا مُوْسٰى اِمَّا اَنْ تُلْقِىَ وَاِمَّا اَنْ نَّكُوْنَ نَحْنُ الْمُلْقِيْنَ○


অর্থঃ তারা বললো, হে মুসা, হয় আপনি নিক্ষেপ করুন না-হয় আমরা নিক্ষেপকারী হই। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৫)


যাদুকরদের এই উক্তিটি ছিল নিজেদের নিশ্চিন্ততা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে যে, এ ব্যাপারে আমাদের কোন পরোয়াই নেই- প্রথমে আমরা শুরু করবো, না আপনি। কারণ, আমরা নিজেদের যাদুশাস্ত্রের ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশ্বস্ত।


তাদের বর্ণনাভঙ্গিতে একথা বুঝা যায় যে, তারা মনে মনে প্রথম আক্রমণের প্রত্যাশী ছিল। কিন্তু নিজেদের শক্তিমত্তা ও বাহাদুরি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করে নিলো, প্রথমে আপনি আরম্ভ করবেন, না আমরা।


হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম তাদের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে নিজের মুজিযা সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চয়তার দরুন প্রথমে তাদেরই সুযোগ দিলেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায়,   قَالَ اَلْقُوْا   “তিনি বললেন, তোমরাই আগে নিক্ষেপ করো।”


আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাসীর রহ. তার বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরুল কুরআনিল আযীমে” একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, যাদুকররা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের প্রতি আদব প্রদর্শন ও সম্মানজনক ব্যবহার করতে গিয়েই প্রথম সুযোগ নেওয়ার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাই এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ঈমান আনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে আগেই বলা হয়েছে, মুসা ‘আলাইহিস সালাম সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে তাদেরই প্রথমে নিক্ষেপ করার জন্য বললেন।


সুতরাং যাদুকররা-ই প্রথমে তাদের লাঠি ও দড়িগুলো নিক্ষেপ করলো। সঙ্গে সঙ্গে সেসব দিয়ে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, এক আয়াতে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, 


فَلَمَّا اَلْقَوْا سَحَرُوْا اَعْيُنَ النَّاسِ وَاسْتَرْهَبُوهُمْ وَجَاءُوْا بِسِحْرٍ عَظِيْمٍ○


অর্থঃ যখন তারা নিক্ষেপ করলো, তখন তারা লোকদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিলো এবং তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুললো। তারা প্রদর্শন করলো এক মহাযাদু। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৬)


অর্থাৎ যাদুকররা তাদের লাঠি ও রশিগুলো মাটিতে নিক্ষেপ করার সাথে সাথে সেগুলো বড় বড় সাপ হয়ে ছোটাছুটি শুরু করলো। এভাবে তারা দর্শকদের নজরবন্দি করে দিয়ে এক মস্তবড় যাদু দেখালো। তাদের যাদু দিয়ে উপস্থিত লোকজন খুবই প্রভাবান্বিত হলো এবং বড় বড় বহুসংখ্যক সাপ দেখে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেল।


এই আয়াতের দিয়ে বুঝা যায়, তাদের যাদু ছিল একপ্রকার নজরবন্দি। যাতে দর্শকদের মনে থেকে লাগলো, এই লাঠি ও দড়িগুলো সাপ হয়ে ছোটাছুটি করছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আগের মতোই লাঠি ও দড়ি ছিল। বাস্তবে সেগুলো কোন সাপ হয়নি। বস্তুত এটা এক প্রকার সম্মোহনীশক্তি ছিলো, যার প্রভাব মানুষের কল্পনা ও দৃষ্টিকে ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো।


এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা‘আলা তার নবী হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে যে নির্দেশ দিলেন, কুরআন মজীদের এক আয়াতে এভাবে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, 


وَاَوْحَيْنَا اِلٰى مُوسٰى اَنْ اَلْقِ عَصَاكَ فَاِذَا هِىَ تَلْقَفُ مَا يَاْفِكُوْنَ○


অর্থঃ তারপর আমি ওহীর মাধ্যমে মুসা ‘আলাইহিস সালামকে বললাম, আপনার লাঠিখানা নিক্ষেপ করুন। তা নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে সে (মুসা ‘আলাইহিস সালাম এর সাপ), সবগুলোকে (যাদুকরদের সাপগুলোকে) গিলতে লাগলো, যা তারা বানিয়েছিল যাদুর বলে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৭)


অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে মুসা ‘আলাইহিস সালাম তার লাঠিখানা মাটিতে ফেলে দিতেই লাঠিটি সবচেয়ে বড় সাপে পরিণত হয়ে যাদুকরদের সকল সাপ গিলে খেতে শুরু করলো।

ঐতিহাসিক-বর্ণনায় রয়েছে, হাজার হাজার যাদুকরের হাজার হাজার লাঠি ও রশি যখন সাপ হয়ে দৌড়াতে লাগলো, তখন সমগ্র মাঠ সাপে ভরে গেল এবং সমবেত দর্শকদের মাঝে তাতে এক অদ্ভুত ভীতির সঞ্চার হলো। এমনকি হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামও কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কুরআনে কারীমে এই দিকেই ইংগিত করে বলা হয়েছে, 


فَاِذَا حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ اِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ اَنَّهَا تَسْعٰى○ فَاَوْجَسَ فِىْ نَفْسِه خِيْفَةً مُّوْسٰى○ قُلْنَا لَا تَخَفْ اِنَّكَ اَنْتَ الْاَعْلٰى○


অর্থঃ তাদের যাদুক্রিয়ার প্রভাবে তার মনে হলো, যেন হঠাৎ তাদের রশি ও লাঠিগুলো সাপ হয়ে ছোটাছুটি করছে। তখন মুসা ‘আলাইহিস সালাম মনে মনে কিছুটা ভীতি অনুভব করলেন। আমি বললাম, ভয় করবেন না, নিশ্চয় আপনিই বিজয়ী হবেন। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৬৬-৬৮)


কিন্তু হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম তার এই ভয় মনের ভেতর গোপন রাখলেন। প্রকাশ হতে দেননি। এই ভয় যদি প্রাণনাশের ভয় হয়ে থাকে, তবে মানুষ হিসাবে এরূপ হওয়া নবুওয়্যাতের পরিপন্থী নয়। কিন্তু বাহ্যত বুঝা যায়, এটা প্রাণনাশের ভয় ছিল না; বরং তিনি আশঙ্কা করছিলেন, এরা লাঠি ও দড়ি ফেলেছে, তাতে সেগুলো সাপ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় যখন আমি লাঠি ফেলবো, তাও সাপ হয়ে যাবে। তাতে তো সব এক রকমই হয়ে গেল। সুতরাং মানুষ নবুওয়্যাতের মুজিযার পার্থক্য করবে কিভাবে!


অপরদিকে তিনি ভাবলেন, আমার সাপ মাত্র একটা হবে, অথচ তাদের সাপের সংখ্যা অনেক বেশি। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ মহাসমাবেশের সামনে যদি যাদুকররা জিতে যায়, তবে নবুওয়্যাতের দাওয়াতের উদ্দেশ্য তো পূর্ণ হতে পারবে না। এর জবাবে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 


لَا تَخَفْ اِنَّكَ اَنْتَ الْاَعْلٰى


অর্থঃ আপনি ভয় পাবেন না, আপনিই বিজয়ী হবেন।


এতে আল্লাহর নবী হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যাদুকররা জয়ী হতে পারবে না। আপনিই তাদের উপর বিজয় ও প্রাধান্য লাভ করবেন। এভাবে তার উপরোক্ত আশঙ্কা দূর করে দেওয়া হয়।