Saturday, March 18, 2023

নবী-রাসূল আ. এর ওপর ঈমান

 ৪. নবী-রাসূল আ. এর ওপর ঈমান


নবী-রাসূল আ.- এর ওপর ঈমান আনার অর্থ এ কথা বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের হিদায়াতের জন্যে এবং তাদেরকে সঠিক পথ দেখাবার জন্য স্বীয় বান্দাদের মধ্যে হতে বাছাই করে বহুসংখ্যক পয়গাম্বর অর্থাৎ নবী-রাসূল আ. মনোনীত করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যাতে করে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করে দুনিয়াতে কামিয়াব হতে পারে এবং পরকালে দোযখ থেকে মুক্তি লাভ করে বেহেশত হাসিল করতে পারে।


পয়গাম্বরগণ সকলেই মাসুম বা নিষ্পাপ। তাঁরা কোন প্রকার পাপ করেন না। নবীগণ মানুষ। তাঁরা খোদা নন। খোদার পুত্র নন। খোদার রূপান্তর (অবতার) নন। বরং তাঁরা হলেন আল্লাহর প্রতিনিধি। নবীগণ আল্লাহর বাণী হুবহু পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের সঠিক সংখ্যা কুরআন শরীফ বা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীস শরীফে বর্ণনা করেন নি। কাজেই নিশ্চিতভাবে তাঁদের সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না। এ কথা যদি ও প্রসিদ্ধ যে, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন কিন্তু কোন সহীহ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত নয়। শুধু এতটুকু বলা যায় যে, বহুসংখ্যক পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন।


আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে তাঁদের দ্বারা অনেক অসাধারণ ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ঐ সব ঘটনাকে মু‘জিযা বলে। নবীগণের মু‘জিযাসমূহ বিশ্বাস করাও ঈমানের অঙ্গ। 


পয়গাম্বরগণের আ. মধ্যে সর্বপ্রথম দুনিয়াতে আগমন করেছেন হযরত আদম আ. এবং সর্বশেষ অথচ সর্বপ্রধান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর পরে অন্য কেউ দুনিয়াতে নবী বা রাসূল হিসেবে আগমন করেননি এবং করবেনও না। হযরত ঈসা আ. কিয়ামতের পূর্বে যদিও আগমন করবেন, কিন্তু তিনি তো পূর্বেই নবী ছিলেন। নতুন নবী হিসেবে তিনি আগমন করবেন না। আমদের নবী খাতামুন নাবিয়্যীন বা শেষনবী। তাঁর পরে নতুনভাবে আর কোন নবী আসবেন না; তারপর আসল বা ছায়া কোনরূপ নবীই নাই। বরং তাঁর আগমনের মাধ্যমে নবুওয়াতের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের নবীর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে যত জিন বা ইনসান ছিল, আছে বা সৃষ্টি হবে, সকলের জন্যেই তিনি নবী। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবীতে একমাত্র তাঁরই হুকুম এবং তরীকা সকলের মুক্তি ও নাজাতের জন্যে অদ্বিতীয় পথ হিসেবে বহাল থাকবে। অন্য কোন ধর্ম, তরীকা বা ইজম এর অনুসরণ কাউকে আল্লাহর দরবারে কামিয়াব করতে পারবে না। আমাদের নবীর পরে অন্য কেউ নবী হয়েছেন বা নবী হবেন বলে বিশ্বাস করলে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। তেমনিভাবে কেউ নতুন নবী হওয়ার দাবি করলে বা তার অনুসরণ করলে, সেও কাফির বলে গণ্য হবে। 


হযরত ঈসা আ. এখনও আসমানে জীবিত আছেন। তাঁকে জীবিত অবস্থায় আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন, ইহা সত্য। কুরআন হাদীসে প্রমাণিত। তাই ইহা বিশ্বাস করতে হবে, অন্যথায় ঈমান থাকবে না, তিনি কিয়ামতের পূর্বে আসমান থেকে জমিনে অবতরণ করবেন। আমাদের নবীর অনুসারী হয়ে। হযরত ঈসা আ.- এর ব্যাপারে পুত্রবাদ ও কর্তৃত্বদের বিশ্বাস কুফরী। 


দুনিয়াতে যত পয়গাম্বর এসেছেন, সকলেই আমাদের মাননীয় ও ভক্তির পাত্র। তাঁরা সকলেই আল্লাহর হুকুম প্রচার করেছেন। তাঁদের মধ্যে পরস্পরে কোন বিরোধ ছিল না। সকলেই পরস্পর ভাই ভাই ছিলেন। হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্য হিকমতের কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হুকুম জারি করেছেন। আর এই সামান্য বিভিন্নতাও শুধু আমলের ব্যাপারে, ঈমান আকীদার ব্যাপারে নয়। আকীদাসমূহ আদি হতে অন্ত পর্যন্ত চিরকাল এক। আক্বীদার মধ্যে কোন প্রকার রদবদল বা পরিবর্তন হয়নি, আর হবেও না কখনো। পয়গাম্বরগণ সকলেই কামিল ছিলেন। কেও নাকিস বা অসম্পূর্ণ ছিলেন না। অবশ্য তাঁদের মধ্যে কারো মর্যাদা ছিল বেশি, কারো মর্যাদা ছিল তুলনামূলকভাবে কম। সকল নবী নিজ নিজ কবরে জীবিত আছেন। এজন্য নবীগণকে ‘হায়াতুন্নবী’ বলা হয়।


উল্লেখ্য যে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্তবা সর্বাপেক্ষা বেশি। তাই বলে নবীগণের মধ্যে তুলনা করে একজনকে বড় এবং একজনকে হেয় বা ছোট করে দেখানো বা বর্ণনা করা নিষেধ। 


নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম-এর সমস্ত কথা মেনে নেয়া জরুরী। তাঁর একটি কথাও অবিশ্বাস করলে বা সে সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করলে কিংবা তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করলে বা দোষ বের করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।


ঈমানের জন্যে আমাদের নবীর সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মি‘রাজ ভ্রমণের কথা বিশ্বাস করাও জরুরী। যে মি‘রাজ বিশ্বাস করে না, সে বেদ্বীন। তার ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। 


সাহাবীর পরিচিতিঃ

যেসব মুসলমান আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে স্বচক্ষে দেখেছেন, এবং ঈমানের হালতে ইনতিকাল করেছেন, তাঁদেরকে ‘সাহাবী’ বলা হয়। সাহাবীগণের অনেক ফযীলতের কথা কুরআন ও হাদীসে এসেছে। সমস্ত সাহাবী রা. গণের সাথে মুহাব্বত রাখা ও তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। 


তাঁদের কাউকে মন্দ বলা আমদের জন্যে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। সাহাবীগণ যদিও মাসুম বা নিষ্পাপ নন, কিন্তু তাঁরা মাগফূর বা ক্ষমাপ্রাপ্ত। সুতরাং, পরবর্তী লোকদের জন্য তাঁদের সমালোচনা করার কোন অধিকার নেই। তাঁরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। 


তাঁরা সকলেই আদিল অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য সত্যবাদী এবং সত্যের মাপকাঠি। তাঁদের দোষ চর্চা করা হারাম এবং ঈমান বিধ্বংসী কাজ। ‘আকীদাতুত তাহাবী’ কিতাবে উল্লেখ আছে, ‘সাহাবীগণের প্রতি মুহাব্বত-ভক্তি রাখা দ্বীনদারী ও ঈমানদারী এবং দ্বীনের ও ঈমানের পূর্ণতা। আর তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা বা তাদের বিরূপ সমালোচনা করা কুফরী, মুনাফেকী এবং শরী‘আতের সীমার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।


সমস্ত সাহাবীগণের মাঝে চারজন সর্বপ্রধান। তাঁদের মধ্যে প্রথম হচ্ছেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা., তিনিই প্রথম খলীফা বরহক এবং তিনি সমস্ত উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক রা., তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান গণী রা. এবং চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা.। সকল সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার চির সন্তুষ্টির সুসংবাদ দিয়েছেন। বিশেষ করে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন। এই দশজনকে আশারায়ে মুবাশশারা (সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন) বলা হয়। তাঁরা হলেন -১. হযরত আবু বকর রা., ২. হযরত ওমর ফারুক রা., ৩। হযরত উসমান রা. ৪. হযরত আলী রা., ৫. হযরত তালহা রা., ৬. হযরত যুবায়ের রা. ৭. হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা., ৮. হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াককাস রা., ৯. হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ রা., ১০. হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা.


নবী আ. এর বিবি ও আওলাদ সম্বন্ধে আক্বীদাঃ

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিবি ও আহল-আওলাদগণের রা. বিশেষভাবে তাযীম করা উম্মতের ওপর ওয়াজিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আওলাদগণের মধ্যে হযরত ফাতিমা রা. এবং বিবিগণের মধ্যে হযরত খাদীজা ও আয়িশা রা. এর মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। 


ওলী-বুযুর্গদের সম্বন্ধে আক্বীদাঃ

ওলী-বুযুর্গদের কারামত সত্য। কিন্তু ওলী-বুযুর্গগণ যত বড়ই হোন না কেন, তাঁরা নবী রাসূল আ. তো দূরের কথা, একজন সাধারণ সাহাবীর সমতুল্যও হতে পারেন না। অবশ্য হক্কানী পীর-মাশায়িখ ও উলামায়ে কিরাম যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়ারিশ এবং দ্বীনের ধারক বাহক সুতরাং, তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা রাখা, তাঁদের সঙ্গ লাভ করা এবং তাদের প্রতি বিদ্বেষ না রাখা সকল মুসলমানের জন্য জরুরী। দ্বীনের খাদিম হিসেবে তাঁদেরকে হেয় করা, কিংবা গালি দেয়া কুফরী কাজ। মানুষ যতই খোদার পেয়ারা হোক, হুঁশ-জ্ঞান থাকতে শরী‘আতের হুকুম-আহকামের পাবন্দী অবশ্যই তাকে করতে হবে। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত কখনো মাফ হবে না। তেমনিভাবে মদ খাওয়া, গান-বাদ্য করা, পরস্ত্রী দর্শন বা স্পর্শ করা কখনো তার জন্যে জায়িয হবে না। হারাম বস্তুসমূহ হারামই থাকবে এবং হারাম কাজ করে বা ফরয বন্দেগী ছেড়ে দিয়ে কেউ কখনো আল্লাহর ওলী হতে পারে না 

ফেরেশতাগণের ওপর ঈমান

 ২. ফেরেশতাগণের ওপর ঈমান


ফেরেশতাগণের ওপর ঈমান আনার অর্থ হলো এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ এক ধরণের মাখলুককে নূরের দ্বারা সৃষ্টি করে তাদেরকে আমাদের চক্ষুর অন্তরালে রেখেছেন। তাদেরকে ফেরেশতা বলে। তাঁরা পুরুষ বা মহিলা কোনটিই নন। বরং তাঁরা ভিন্ন ধরনের মাখলুক। অনেক ধরণের কাজ আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর সোপর্দ করে রেখেছেন। যেমন: নবীগণের আ. নিকট অহী আনয়ন করা, মেঘ পরিচালনা করা, রুহু কবয করা, নেকী-বদী লিখে রাখা ইত্যাদি। তাঁরা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। তাঁরা বিন্দুমাত্র আল্লাহর নাফরমানী করেন না। তাঁরা আল্লাহর প্রিয় ও ফরমাবরদার বান্দা। তাঁদের মধ্যে চারজন ফেরেশতা যথা: হযরত জিবরাঈল আ. হযরত মীকাঈল আ., হযরত ইসরাফীল আ. ও হযরত আযরাঈল আ. অতিপ্রসিদ্ধ । 


জিন সম্বন্ধে আক্বীদা:

আরেক প্রকার জীবকে আল্লাহ তা‘আলা আগুনের দ্বারা সৃষ্টি করে আমাদের চক্ষুর অগোচর করে রেখেছেন। তাদেরকে জিন বলে। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ সবরকম হয়। তারা নারী-পুরুষও বটে এবং তাদের সন্তানাদিও হয়। তাদের খানা-পিনার প্রয়োজনও হয়। জিন মানুষের ওপর আছর করতে পারে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও বড় দুষ্ট হচ্ছে ‘ইবলিশ শয়তান’। হাশরের ময়দানে জিনদেরও হিসাব-নিকাশ হবে। এ কথা কুরআনে কারীমে উল্লেখ আছে। সুতরাং তা বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ।