ইমাম আবূ হানীফা রহ.এর শ্রেষ্ঠত্ব
অনুসৃত চার মাযাহাবের মান্যবর চার ইমামের প্রত্যেকেই কুরআন-হাদীস সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ছিলেন এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। তবে তুলনামূলক বিচারে ইমাম আবূ হনীফা রহ. ছিলেন তাদের সর্বশ্রেষ্ঠজন। ফিকহশাস্ত্র সংকলন ও এর প্রচার-প্রসারে তাঁর বিস্ময়কর অবদান সম্পর্কে ছিটেফোঁটা অবগতি থাকলেও ইনসাফপ্রিয় প্রতিটি মানুষ এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। ফিকহশাস্ত্রে তাঁর অবদানের কথা আলোচনার পূর্বে আমরা ফিকহশাস্ত্র ও এর ক্রমবিকাশ নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় শরী‘আতের বিধানাবলীর মান নির্ণীত ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সামনে উযু করতেন। মুখে বলতেন না যে, এটা ফরজ, এটা ওয়াজিব আর এটা মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে দেখে ঠিক সেভাবে উযু করতেন। নামাযের অবস্থাও ছিল তাই। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম ফরজ, ওয়াজিব ইত্যাদির বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিতেন না বা নেয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না। তাঁরা যেভাবে রাসূল ﷺ -কে নামায আদায় করতে দেখতেন হুবহু সেভাবেই নিজেরা নামায আদায় করতেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি কোন জাতিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবাদের চেয়ে উত্তম দেখিনি। কিন্তু তাঁরা নবীজীর গোটা জীবনে ‘তেরো’র অধিক মাসআলা জিজ্ঞেস করেননি। এর সবগুলোই আবার কুরআনে কারীমে বিদ্যমান। যে সমস্যাগুলো না জানলেই নয় সেগুলোই কেবল জিজ্ঞেস করতেন। (সুনানে দারেমী-মুকাদ্দিমা ১২৭)
অনেক সময় এমন হতো যে, কেউ কোন কাজ করেছে, তিনি সেটাকে ভালো বলেছেন অথবা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এভাবে আদেশ নিষেধ সাধারণ সমাবেশে প্রকাশ পেত। আর সাহাবায়ে কেরাম সে পরিস্থিতিতে প্রদত্ত নবীজীর বক্তব্য স্মরণ রাখতেন। নবীজীর ইন্তেকালের পর ইসলামের বিজয় নিশান দূর-দুরান্তে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে সামাজিক জীবনের পরিধিও বর্ধিত হতে লাগল। সমস্যা এত বেশি ঘটতে লাগল যে, ইজতিহাদ ও মাসআলা আহরণের প্রয়োজন দেখা দিল। এতে কুরআন-হাদিসে বর্ণিত সংক্ষিপ্ত বিধি-নিষেধের বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রতি মনোযোগ দিতে হলো।
উদাহরণতঃ কেউ নামাযে ভুলক্রমে কোন আমল ছেড়ে দিল। এখন বিতর্ক এই দেখা দিল যে, তার নামায হলো কি হলো না, তো এর সমাধান কল্পে নামাযের কার্যাবলির সবগুলোকেই ফরজ বলে দেয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই সাহাবায়ে কেরামকে নামাযের কার্যাবলির মান নির্ণয় করে নিতে হয়েছে যে, এই এই কাজ ফরজ, ওয়াজিব আর এগুলো সুন্নাত বা মুস্তাহাব। বলাবাহুল্য আমলগুলোর মান নির্ণয়ের এ ইজতিহাদ ও গবেষণায় যে মূলনীতি অনুসরণ করা হতো, সে ব্যাপারে সকল সাহাবীর একমত হওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্য মাসআলাসমূহে মতভেদ দেখা দিয়েছে এবং অধিকাংশ মাসআলায় সাহাবাদের মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া এরূপ অনেক ঘটনারও উদ্ভব ঘটেছে, যেগুলোর মূল ছিল নবীযুগে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা। এরূপ ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামকে মূল ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তার শাখা-প্রশাখা চিহ্নিত করে অতঃপর চলমান ঘটনাকে অনুরূপ ঘটনার সাথে সমন্বিত করে সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে। এই যে বিশ্বস্ত ও বিশেষজ্ঞ গবেষক কর্তৃক যথাযোগ্য পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কুরআন-হাদীসের ব্যবহারিক দিকটিকে উদ্ঘাটন ও আহরণ করা পরিভাষায় একে বলা হয় ইজতিহাদ। আর উদঘাটিত ও আহরিত মাসআলাকে বলা হয় ফিকহ। ফিকহ কুরআন-হাদীস বর্হিভুত কোনো বস্তু নয়; বরং কুরআন-হাদীসেরই ব্যবহারিক দিক।