Friday, March 10, 2023

ইউসুফ আ. কে হত্যার পরিকল্পনা

 ইউসুফ আ. কে হত্যার পরিকল্পনা


পরামর্শের এক পর্যায়ে তাদের একজন এ মত পেশ করলো যে, ইউসুফকে হত্যা করা হোক। অন্য একজন বললো, তাকে হত্যা না করে কোনো দূরদেশে ফেলে আসা হোক। এতে করে মাঝখান থেকে এ কাঁটা দূর হয়ে যাবে এবং পিতার সব মনোযোগ আমাদের প্রতিই নিবদ্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তাকে হত্যা কিংবা দেশান্তরের কারণে যে গুনাহ হবে, তার প্রতিকার এই যে, পরবর্তীকালে তাওবা করে আমরা ভালো হয়ে যাবো। শিরোনামে উল্লিখিত “এবং তারপর ভালো হয়ে যাবো” বাক্যের এক অর্থ তা-ই বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফকে হত্যা করার পর আমাদের অবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। কেননা, তখন পিতার মনোযোগের কেন্দ্র শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং মনোযোগ আমাদের দিকেই নিবদ্ধ হবে এবং আমরা ভালো পরিগণিত হবো।


সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যেরই একজন সমস্ত কথাবার্তা শুনে বললো, ইউসুফকে হত্যা করা উচিৎ হবে না। বরং যদি কিছু করতেই হয়, তবে তাকে কূপের গভীরে এমন জায়গায় নিক্ষেপ করা হোক, যেখানে সে জীবিত থাকবে এবং পথিক যখন কূপে আসবে, তখন তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। এভাবে একদিকে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে এবং চিন্তা করতে হবে না। বরং এমতাবস্থায় কোন পথিকই তাকে দূরদেশে নিয়ে চলে যাবে। 


এ অভিমত প্রকাশকারী ছিলো তাদের বড় ভাই ইয়াহুদা। কোন কোন রিওয়ায়েতে আছে যে, সবার মধ্যে রুবীল ছিল বড়। সে-ই এ অভিমত ব্যক্ত করছিল। এ ব্যক্তি সম্পর্কে সামনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিসরে যখন ইউসুফ আ. এর ছোট ভাই বিনয়ামীনকে আটক করা হয়, তখন সে বলেছিলো, আমি ফিরে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবো? তাই আমি আর কেনানে ফিরে যাবো না।



পরিকল্পনার বাস্তবায়ন


হযরত ইউসুফ আ. এর ভায়েরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পিতার কাছে এভাবে আবেদন পেশ করলো যে, আব্বাজান! ব্যাপার কী! আপনি দেখি ইউসুফ সম্পর্কে আমাদের প্রতি আস্থা রাখেন না! অথচ আমরা তার পুরোপুরি হিতাকাঙ্ক্ষী। আগামীকাল আপনি তাকে আমাদের সাথে ভ্রমণে পাঠিয়ে দিন, যাতে সেও স্বাধীনভাবে পানাহার ও খেলাধুলা করতে পারে। আমরা সবাই তার পুরোপুরি দেখাশোনা করবো।


তাদের এ আবেদন থেকেই বোঝা যায় যে, এর আগেও তারা কোনো সময় এ ধরনের আবেদন করেছিল, যা পিতা অগ্রাহ্য করেছিলেন। যদ্দরূণ এবার কিঞ্চিত জোর ও পীড়াপীড়ি সহকারে পিতাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ আবেদন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,


قَالُوْا یٰۤاَبَانَا مَا لَکَ لَا تَاْمَنَّا عَلٰی یُوْسُفَ وَ اِنَّا لَهٗ لَنٰصِحُوْنَ○ اَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًا یَّرْتَعْ وَیَلْعَبْ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ○


অর্থঃ তারা বললো, হে আমাদের আব্বা! আপনার কী হয়েছে যে, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশ্বাস করেন না? অথচ আমরা তো তার শুভাকাঙ্ক্ষী। আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে প্রেরণ করুন। তাহলে সে তৃপ্তিসহ খাবে এবং খেলাধুলা করবে, আর আমরা অবশ্যই তার হিফাযত করবো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১১-১২)


ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা যখন আগামীকাল ইউসুফকে তাদের সাথে ভ্রমণে পাঠানোর আবেদন করলো, তখন হযরত ইয়াকূব আ. বললেন, তাকে পাঠানো আমি দু’কারণে পছন্দ করি না। প্রথমতঃ সে নয়নের মণি, আমার সামনে না থাকলে, আমি শান্তি পাই না। দ্বিতীয়তঃ আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, জঙ্গলে তোমাদের অসাবধানতার মুহূর্তে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলতে পারে। 


ইয়াকূব আ. এর এ বক্তব্য কালামে পাকের এ আয়াতে বিবৃত হয়েছে, 


قَالَ اِنِّیْ لَیَحْزُنُنِیْۤ اَنْ تَذْهَبُوْا بِهٖ وَ اَخَافُ اَنْ یَّاْكُلَهُ الذِّئْبُ وَاَنْتُمْ عَنْهُ غٰفِلُوْنَ○


অর্থঃ ইয়াকূব আ. বললেন, আমার দুশ্চিন্তা হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশঙ্কা করি যে, বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে, অথচ তোমরা তার থেকে অমনোযোগী থাকবে। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৩)


বাঘের আশঙ্কা হওয়ার কারণ এই যে, তখন কেনানে বাঘের খুব উপদ্রব ছিল। ওদিকে হযরত ইয়াকূব আ. স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি পাহাড়ের উপর আছেন। নীচে পাহাড়ের পাদদেশে ইউসুফ আ.। হঠাৎ দশটি বাঘ এসে তাঁকে ঘেরাও করে ফেলে এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু সেগুলোর মধ্য থেকে একটি বাঘ এসে তাঁকে মুক্ত করে দেয়, অতঃপর ইউসুফ আ. মাটির অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেন। 


এর ব্যাখ্যা এভাবে প্রকাশ পায় যে, দশটি বাঘ ছিল দশজন ভাই এবং যে বাঘটি তাঁকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে, সে ছিল বড় ভাই ইয়াহুদা অথবা রুবীল। আর মাটির অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেয়ার অর্থ, কূপের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ স্বপ্নের ভিত্তিতে হযরত ইয়াকূব আ. স্বয়ং এ ভাইদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন এবং তাদরকেই বাঘ বলেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে ওদের কাছে কথা প্রকাশ করেননি। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন লিল কুরতুবী)


ভাইয়েরা হযরত ইয়াকূব আ. এর এ কথা শুনে বললো, আপনার এ ভয়-ভীতি অমূলক। আমরা দশজনের শক্তিশালী দল তার হেফাজাতের জন্য বিদ্যমান রয়েছি। আমাদের সবার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘেই তাকে খেয়ে ফেলে, তাহলে আমাদের অস্তিত্বই নিষ্ফল হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় আমাদের দিয়ে কোন্ কাজের আশা করা যেতে পারে?


নিম্নোলিখিত আয়াতে ইউসুফ আ. এর ভোইদের সেই কথা বর্ণনা করা হয়েছে, 


قَالُوْا لَئِنْ اَکَلَهُ الذِّئْبُ وَنَحْنُ عُصْبَۃٌ اِنَّاۤ اِذًا لَّخٰسِرُوْنَ○


অর্থঃ তারা বললো, আমরা একটি ভারী দল থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘ তাকে খেয়ে ফেলে, তবে তো আমরা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৪)


হযরত ইয়াকূব আ. পয়গাম্বরসুলভ গাম্ভীর্যের কারণে ছেলেদের সামনে এ কথা প্রকাশ করলেন না যে, আমি স্বয়ং তোমাদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করি। কারণ এতে প্রথমতঃ তাদের মনোকষ্ট হতো, দ্বিতীয়তঃ পিতার এরূপ বলার দিয়ে ভাইদের শত্রুতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে এখন ছেড়ে দিলেও অন্য কোনো সময় কোনো ছলছুতায় তাঁকে হত্যা করার ফিকিরে থাকতো। তাই তিনি তাঁকে নিয়ে যাবার অনুমতি দিয়ে দিলেন। তবে ভাইদের কাছ থেকে অঙ্গীকারও নিয়ে নিলেন, যাতে ইউসুফের কোনো রকম কষ্ট না হয়। এ পর্যায়ে বিশেষ করে বড় ভাই ইয়াহুদার হাতে তাকে সোপর্দ করে বললেন, তুমি তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও অন্যান্য প্রয়োজনের ব্যাপারে খেয়াল রাখবে এবং শীঘ্র ফিরিয়ে আনবে।


ভাইরা পিতার সামনে ইউসুফকে কাঁধে তুলে নিলো এবং পালাক্রমে সবাই উঠাতে লাগলো। কিছু দূর পর্যন্ত হযরত ইয়াকূর আ. ও তাদেরকে বিদায় জানানোর জন্যে গেলেন।


ইমাম কুরতুবী রহ. ঐতিহাসিক রিওয়ায়েতের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, তারা যখন হযরত ইয়াকূব আ. এর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, তখন তারা ইউসুফ আ. কে নামিয়ে দিল এবং তিনি পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। কিন্তু অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে তাদের সাথে সাথে চলতে অক্ষম হচ্ছিলেন আবার তাকে হত্যা করার ব্যাপারে ভাইদের পরামর্শও টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি এক ভাইয়ের আশ্রয় নিতে চাইলেন। সে কোনোরূপ সহানুভূতি প্রদর্শন না করায় তৃতীয়, চতুর্থ; এমনিভাবে প্রত্যেক ভাইয়ের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু সবাই উত্তর দিল যে, তুই যে এগারোটি নক্ষত্র এবং চাঁদ ও সূর্য তোকে সিজদা করতে দেখেছিস, তাদেরকে ডাক দে, তারাই তোকে সাহায্য করবে, আমরা তোকে সাহায্য করতে পারবো না। 


ইমাম কুরতুবী রহ. এর ভিত্তিতে বলেন যে, এ থেকে বোঝা যায় ভাইয়ের কোনো না কোনো উপায়ে ইউসুফ আ. এর স্বপ্নের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। সে স্বপ্ন ইউসুফ আ. এর প্রতি তাদের তীব্র ক্রোধ ও কঠোর ব্যবহারের কারণ হয়েছিল। উক্ত স্বপ্নের কারণেই তারা ইউসুফ আ. এর সাথে হিংসাত্মক আচরণ করেছিল। 


অবশেষে ইউসুফ আ. ইয়াহুদাকে বললেন, আপনি সবার বড়। আপনিই আমার দুর্বলতা ও অল্পবয়স্কতা এবং পিতার মনোকষ্টের কথা চিন্তা করে দয়ার্দ্র হোন। আপনি ঐ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করুন যা পিতার সাথে করেছিলেন। একথা শুনে ইয়াহুদার মনে দয়ার সঞ্চার হলো এবং তাকে বললো, যতক্ষণ আমি জীবিত আছি, এসব ভাই তোমাকে কোনো কষ্ট দিতে পারবে না। 


তখন ইয়াহুদার অন্তরে আল্লাহ তা‘আলা দয়া ও ন্যায়ানুগ কাজ করার প্রেরণা জাগ্রত করে দিলেন। সে অন্যান্য ভাইকে সম্বোধন করে বললো, নিরপরাধকে হত্যা করা মহাপাপ। আল্লাহকে ভয় করো এবং বালকটিকে তার পিতার কাছে নিয়ে চলো। তবে তার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে নাও যে, সে পিতার কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করবে না। ভাইয়ের উত্তর দিল, আমরা জানি, তোমার উদ্দেশ্য কী? তুমি পিতার অন্তরে নিজের মর্যাদার আসন সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও। মনে রাখো, যদি তুমি আমাদের ইচ্ছা পূরণে প্রতিবন্ধক হও, তবে আমরা তোমাকেও হত্যা করবো। 


ইয়াহুদা দেখলো যে, নয় ভাইয়ের বিপরীতে সে একা কিছু করতে পারবে না। তাই সে বললো, তোমরা যদি এ বালককে নিপাত করতে মনস্থ করে থাকো, তবে আমার কথা শোনো, নিকটেই একটি প্রাচীন কূপ রয়েছে। এতে অনেক ঝোপ-জঙ্গল গজিয়েছে। সাপ, বিচ্ছু ও হরেক রকমের ইতর প্রাণী এখানে বাস করে। তোমরা তাকে সেই কূপে ফেলে দাও। যদি কোনো সাপ ইত্যাদি তাকে দংশন করে শেষ করে দেয়, তবে তোমাদের উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে এবং নিজ হাতে হত্যা করার দোষ থেকে তোমরা মুক্ত থাকবে। পক্ষান্তরে যদি সে জীবিত থাকে, তবে হয়তো কোনো কাফেলা এখানে আসবে এবং পানির জন্য কূপে বালতি ফেলবে। ফলে সে বের হয়ে আসবে। আর তারা তাকে সাথে করে অন্য কোনো দেশে পৌঁছে দেবে। এমতাবস্থায়ও তোমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে।



ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ


এ প্রস্তাবে ভাইয়েরা সবাই একমত হলো। তাদের এ বিষয়টি নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে,  


فَلَمَّا ذَهَبُوْا بِهٖ وَ اَجْمَعُوْۤا اَنْ یَّجْعَلُوْهُ فِیْ غَیٰبَتِ الْجُبِّ ۚ وَ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمْ بِاَمْرِهِمْ هٰذَا وَهُمْ لَا یَشْعُرُوْنَ○


অর্থঃ অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে চললো, এবং অন্ধকার কূপের গভীরে নিক্ষেপ করতে একমত হলো, তখন আমি তাকে ওহী দিয়ে জানিয়ে দিলাম যে, অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কাজের কথা এক সময় স্মরণ করিয়ে দিবে, আর তারা তখন তোমার উঁচু মর্যাদার কারণে তোমাকে চিনবে না। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৫)


ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এ ওহী সম্পর্কে দু প্রকার ব্যাখ্যা থেকে পারে। (এক) কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাঁর সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদ দানের জন্য এ ওহী পাঠানো হয়েছিল। (দুই) কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে ইউসুফ আ. কে ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী জানিয়ে দিয়েছিলেন। এতে আরো বলে দিয়েছিলেন যে, তুমি এভাবে ধ্বংস হওয়ার কবল থেকে মুক্ত থাকবে এবং এমন পরিস্থিতি দেখা দিবে যে, তুমি তাদের তিরস্কার করার সুযোগ পাবে। অথচ তারা ধারণা করবে না যে, তুমিই তাদের ভাই ইউসুফ। কারণ, তখন তুমি অনেক উচ্চ মর্যাদায় অবস্থান করবে। এক পর্যায়ে তারা হযরত ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলো। তখন তিনি কূপের প্রাচীর জড়িয়ে ধরলেন। ভাইয়েরা তাঁর জামা খুলে তা দিয়ে তাঁর হাত বাঁধলো। তখন ইউসুফ আ. পুনরায় তাদের কাছে দয়া ভিক্ষা চাইলেন। কিন্তু তখনও তারা আগের মতো সেই উত্তরই দিল যে, যে এগারোটি নক্ষত্র তোকে সিজদা করেছিল, তাদেরকে ডাক দে। তারাই তোকে সাহায্য করবে। অতঃপর ভাইয়েরা তাকে বালতিতে ভরে কূপে ছাড়তে লাগলো। সেটা মাঝপথে যেতেই উপর থেকে রশি কেটে দিল। 


আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং ইউসুফ আ. কে হিফাযত করলেন। যদ্দরূণ পানিতে পড়ার কারণে তিনি কোনোরূপ আঘাত পেলেন না। অতঃপর নিকটেই একখণ্ড ভাসমান প্রস্তর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি সুস্থ ও বহাল তবিয়তে তার উপরে বসে রইলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে যে, জিবরাঈল আ. আল্লাহ পাকের আদেশ পেয়ে তাঁকে প্রস্তর খণ্ডের উপর বসিয়ে দেন। ইউসুফ আ. তিন দিন কূপে অবস্থান করেন। ইয়াহুদা প্রত্যহ গোপনে তাঁর জন্য কিছু খাদ্য আনতো এবং বালতির সাহায্যে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতো। ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ করার পর তাঁর ভাইয়েরা সন্ধ্যা বেলায় কান্না করতে করতে তাদের পিতার নিকট উপস্থিত হলো। বিষয়টিকে নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, 


وَجَآءُوْۤا اَبَاهُمْ عِشَآءً یَّبْكُوْنَ○


অর্থঃ আর তারা রাতের অন্ধকারে কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এলো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৬)


হযরত ইয়াকূব আ. কান্নার শব্দ শুনে বাইরে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী! তোমাদের ছাগল পালের উপর কেউ আক্রমণ করেনি তো? ইউসুফ কোথায়? তখন ভাইয়েরা যা বললো, তা পবিত্র কুরআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, 


قَالُوْا یٰۤاَبَانَاۤ اِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا یُوْسُفَ عِنْدَ مَتَاعِنَا فَاَکَلَهُ الذِّئْبُ ۚ وَمَاۤ اَنْتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صٰدِقِیْنَ○


অর্থঃ তারা বললো, হে আমাদের আব্বা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের আসবাবপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। তখন তাকে নেকড়ে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না; যদিও আমরা সত্যবাদী হই। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৭)


ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা তাঁর জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে এনেছিল, যাতে পিতার মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, বাঘই তাঁকে খেয়ে ফেলেছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ প্রতারণার কথা এভাবে বিবৃত হয়েছে, 


وَجَآءُوْ عَلٰی قَمِیْصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ


অর্থঃ তারা ইউসুফের জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে আনলো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮) 


কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের মিথ্যা ফাঁস করে দেয়ার জন্য তাদেরকে একটি জরুরী বিষয় থেকে গাফেল করে দিয়েছিলেন। তারা যদি রক্ত লাগানোর সাথে সাথে জামাটিও ছিন্ন করে দিত, তবে তারা ইউসুফকে বাঘে খাওয়ার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করতে পারতো। কিন্তু তারা অক্ষত জামায় ছাগল ছানার রক্ত মাখিয়ে পিতাকে ধোঁকা দিতে চাইলো। ইয়াকূব আ. অক্ষত জামা দেখে বললেন, বাছারা! এ বাঘ কেমন বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিল যে, ইউসুফকে তো খেয়ে ফেলেছে; কিন্তু জামার কোনো অংশ ছিন্ন হতে দেয়নি! 


এভাবে হযরত ইয়াকূব আ. এর কাছে তাদের জালিয়াতি ফাঁস হয়ে গেলে তিনি যা বললেন, তা কুরআন মাজীদের ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে 


وَجَآءُوْ عَلٰی قَمِیْصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ اَنْفُسُكُمْ اَمْرًا ؕ فَصَبْرٌ جَمِیْلٌ ؕ وَاللهُ الْمُسْتَعَانُ عَلٰی مَا تَصِفُوْنَ○


অর্থঃ ইয়াকূব আ. বললেন, (এটা কারণই নয়;) বরং তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা কথা সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখন পূর্ণ ধৈর্য্য ধারণ করাই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছো, সে সম্বন্ধে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮)


গভীর কূপ থেকে মুক্তি


ওদিকে আল্লাহর মেহেরবানীতে একটি কাফেলা সেই অন্ধকার কূপের কাছে এসে উপস্থিত হয়। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে, এ কাফেলা সিরিয়া থেকে মিসর যাচ্ছিল। পথ ভুলে এ জনমানবহীন জঙ্গলে এসে পড়েছে। তারা পানি সংগ্রহকারীদেরকে পানি খোঁজার জন্য কূপে প্রেরণ করলো। মিসরীয় কাফেলার পথ ভুলে এখানে পৌঁছা এবং এই অন্ধকারকূপের সম্মুখীন হওয়া সাধারণ দৃষ্টিতে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। কিন্তু যারা সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে ভালো জানেন, তারা জানেন যে, এসব ঘটনা একটি অপরটির সাথে পরস্পর সংযুক্ত ও অটুট ব্যবস্থাপনার মিলিত অংশ। হযরত ইউসুফ আ. এর স্রষ্টা ও রক্ষকই কাফেলাকে তাদের গন্তব্যের পথ থেকে সরিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন এবং ইউসুফকে সাহায্য করার জন্য কাফেলার লোকদেরকে এই অন্ধকার কূপে প্রেরণ করেছেন। 

পানি আনার জন্য কাফেলার মালিক ইবনে দোবর নামক জনৈক ব্যক্তি সেই কূপে পৌঁছেন এবং বালতি নিক্ষেপ করলেন। ইউসুফ আ. সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য প্রত্যক্ষ করে বালতির রশি শক্ত করে ধরলেন। পানির পরিবর্তে বালতির সাথে একটি সমুজ্জ্বল মুখমণ্ডল পানি উত্তোলনকারীর দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো। পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে সে কথা ব্যক্ত করা হয়েছে,


وَجَآءَتْ سَیَّارَۃٌ فَاَرْسَلُوْا وَارِدَهُمْ فَاَدْلٰی دَلْوَهٗ ؕ قَالَ یٰبُشْرٰی هٰذَا غُلٰمٌ ؕ وَاَسَرُّوْهُ بِضَاعَۃً ؕ  وَاللهُ عَلِیْمٌۢ بِمَا یَعْمَلُوْنَ○


অর্থঃ একটি কাফেলা এলো। অতঃপর তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করলো। সে নিজের বালতি ফেললো। বললো, কী আনন্দের কথা! এ তো একটি কিশোর! (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৯)


অপ্রত্যাশিতভাবে কূপের তলদেশ থেকে ভেসে ওঠা এই অল্প বয়স্ক অপরূপ ও বুদ্ধিদীপ্ত বালককে দেখে মালেক ইবনে দোবর চিৎকার করে উঠলেন। মুসলিম শরীফে মিরাজ রজনীর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ইউসুফ আ. এর সাথে সাক্ষাতের পর দেখলাম যে, আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র বিশ্বের রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেক তাঁকে দান করেছেন এবং অবশিষ্ট অর্ধেক সমগ্র বিশ্বে বণ্টন করা হয়েছে। 


কাফেলার লোকেরা তখন তাঁকে একটি মূল্যবান পণ্য মনে করে গোপন করে ফেললো। আয়াতের পরবর্তী অংশে সে কথা বলা হয়েছে,


وَاَسَرُّوْهُ بِضَاعَۃً ؕ

অর্থঃ তারা ব্যাবসায়িক পণ্যরূপে তাকে গোপন করে ফেললো।


শুরুতে তো মালেক ইবনে দোবর এ কিশোরকে দেখে অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। কিন্তু পরে চিন্তাভাবনা করে স্থির করলেন যে, এটা জানাজানি না হওয়া উচিত এবং গোপন করে ফেলা দরকার, যাতে একে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ লাভ করা যায়।


অথবা এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা ঐ মুহূর্তে সেখানে এসেছিল। তারা বাস্তব ঘটনা গোপন করে তাঁকে পণ্যদ্রব্য করে নিলো। যেমন, কোনো কোনো রিওয়ায়েতে আছে যে, ইয়াহুদা প্রত্যহ ইউসুফ আ. কে কূপের মধ্যে খানা পৌঁছানোর জন্য যেতো। তৃতীয় দিন তাঁকে কূপের মধ্যে না পেয়ে সে ফিরে এসে ভাইদের কাছে ঘটনা বর্ণনা করলো। অতঃপর সকল ভাই একত্রে সেখানে পৌঁছলো এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর কাফেলার লোকদের কাছ থেকে ইউসুফকে বের করলো। তখন তারা বললো, এ বালকটি আমাদের গোলাম, পলায়ন করে এখানে এসেছে। তোমরা একে কবজায় নিয়ে খুব খারাপ কাজ করেছো। 


একথা শুনে মালেক ইবনে দোবর ও তার সঙ্গীরা ভীত হয়ে গেল যে, তাদেরকে চোর সাব্যস্ত করা হবে। তাই ভাইদের সাথে তাকে ক্রয় করার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে লাগলো। 


এমতাবস্থায় আয়াতের অর্থ এই হবে যে, ইউসুফের ভাইয়েরা, নিজেরাই ইউসুফকে পণ্যদ্রব্য স্থির করে বিক্রি করে দিলো। ইউসুফ আ. এর মতো একজন মহাপুরুষের সঠিক মূল্য সম্পর্কে ভাইয়েরা ছিল অজ্ঞ। আর তাছাড়া ইউসুফ আ. এর ভাইদের আসল উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন ছিল না। আসল উদ্দেশ্যতো ছিলো পিতার কাছ থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। তাই তারা তাঁকে গুটি কতেক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল।


নিম্নেবর্ণিত আয়াতে এ কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে, 


وَشَرَوْهُ بِثَمَنٍۭ بَخْسٍ دَرَاهِمَ مَعْدُوْدَۃٍ ۚ وَکَانُوْا فِیْهِ مِنَ الزَّاهِدِیْنَ○


অর্থঃ তারা তাকে বিক্রি করে দিল অতি অল্পমূল্যে-গুণাগুণিত কয়েক দিরহামে। আর তারা ছিল তাঁর ব্যাপারে নিরাসক্ত। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২০)


কাফেলার লোকেরা তাঁকে মিসর নিয়ে গেলেন। সেখানে নেয়ার পর ইউসুফ আ. কে বিক্রয়ের কথা ঘোষণা করতেই ক্রেতারা প্রতিযোগিতামূলক ভাবে দাম বলতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইউসুফ আ. এর ওজনের সমান স্বর্ণ, সমপরিমাণ মৃগনাভি ও সমপরিমাণ রেশমি বস্ত্র দাম সাব্যস্ত হলো।


ইউসুফ আ. এর স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা

 ইউসুফ আ. এর স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা


হযরত ইউসুফ আ. শৈশবে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, এগারটি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চাঁদ তাকে সিজদা করছে। এই অভিনব স্বপ্ন দেখে পিতার নিকট ব্যক্ত করলে তিনি নবী সুলভ দূরদর্শীতা দিয়ে বুঝতে পারলেন যে, ইউসুফের ভবিষ্যতে মহা মর্যাদা অপেক্ষা করছে। এমনকি সে নবীও হতে পারে। তাই তিনি তাকে আরো অধিক স্নেহ করতে লাগলেন এবং তার এই সৌভাগ্যের সংবাদ অবহিত হয়ে অন্যান্য ভায়েরা তার প্রতি আরো ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতে পারে এবং তাকে কষ্ট দেয়ার পরিকল্পনা করতে পারে ভেবে তিনি ইউসুফকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন যে, তোমার ভাইদের নিকট এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত মোটেও বর্ণনা করো না, তাহলে তোমার বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠবে। কেননা শয়তান তো মানুষের চিরশত্রু । সে চায়না ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক অটুট থাকুক, শান্তিতে বসবাস করুক। কিন্তু মানুষ যেটা আশংকা করে সেটাই হয়ে থাকে। 


হযরত ইউসুফ আ. এর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা দেখলো যে, পিতা ইয়াকূব আ. ইউসুফের প্রতি অসাধারণ মুহাব্বত রাখেন। ফলে তাদের মনে হিংসা মাথা চড়া দিয়ে ওঠে। এটাও হতে পারে যে, তারা কোনোভাবে ইউসুফ আ. এর স্বপ্নের বিষয়ও জানতে পেরেছিলো, যদ্দরূণ তারা হযরত ইউসুফ আ. এর বিরাট মাহাত্ম্যের কথা টের পেয়ে তাঁর প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলো।


তখন তারা পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলো যে, আব্বাজান দেখি আমাদের তুলনায় ইউসুফ ও তার ছোট ভাই বিনয়ামীনকে অধিক ভালোবাসেন। অথচ আমরা দশজন তাদের বড় হওয়ার কারণে ঘরের কাজ-কর্ম করতে সক্ষম। তারা উভয়েই ছোট বালক বিধায় ঘরস্থালির কাজ করার শক্তি রাখে না। আমাদের পিতার উচিৎ হলো, বিষয়টি অনুধাবন করা এবং আমাদেরকে অধিক মুহাব্বত করা। কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে অবিচার করে যাচ্ছেন। তাই এসো, আমরা হয় ইউসুফকে হত্যা করি, না হয় তাকে এমন দূরদেশে নির্বাসিত করি, যেখান থেকে সে আর ফিরে আসতে না পারে।


হযরত ইউসুফ আ. এর ঘটনা ও শিক্ষা

 হযরত ইউসুফ আ. এর ঘটনা ও শিক্ষা


আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


لَقَدْ کَانَ فِیْ یُوسُفَ وَ اِخْوَتِهٖۤ اٰیٰتٌ لِّلسَّآئِلِیْنَ○ اِذْ قَالُوْا لَیُوْسُفُ وَ اَخُوْهُ اَحَبُّ اِلٰۤی اَبِیْنَا مِنَّا وَنَحْنُ عُصْبَۃٌ ؕ اِنَّ اَبَانَا لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنِۣ○ اقْتُلُوْا یُوْسُفَ اَوِاطْرَحُوْهُ اَرْضًا یَّخْلُ لَكُمْ وَجْهُ اَبِیْكُمْ وَتَكُوْنُوْا مِنْۢ بَعْدِهٖ قَوْمًا صٰلِحِیْنَ○ قَالَ قَآئِلٌ مِّنْهُمْ لَا تَقْتُلُوْا یُوْسُفَ وَاَلْقُوْهُ فِیْ غَیٰبَتِ الْجُبِّ یَلْتَقِطْهُ بَعْضُ السَّیَّارَۃِ اِنْ كُنْتُمْ فٰعِلِیْنَ○


অর্থঃ ইউসুফ আ. ও তার ভাইদের কাহিনীতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে প্রশ্নকারীদের জন্য; যখন তারা বললো, অবশ্যই ইউসুফ ও তার ভাই আমাদের পিতার কাছে আমাদের চাইতে অধিক প্রিয়, অথচ আমরা একটি সংহত দল। নিশ্চয় আমাদের পিতা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে রয়েছেন। হয়তো ইউসুফকে হত্যা করো কিংবা তাকে ফেলে রেখে আসো অন্য কোন স্থানে। তাহলে তোমাদের পিতার নেকদৃষ্টি শুধু তোমাদের প্রতিই নিবিষ্ট হবে এবং এরপর তোমরা (তাওবা করে) ভাল মানুষ হয়ে যাবে। তাদের মধ্য থেকে একজন বললো, তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো না, বরং যদি তোমরা কিছু করতেই চাও, তাহলে তাকে কোনো কূপের গভীরে নিক্ষেপ করো, যাতে কোন পথিক তাকে তুলে নিয়ে যায়। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৭-১০)


উল্লিখিত আয়াতসমূহে হযরত ইউসুফ আ. ও তাঁর ভাইদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। হযরত ইউসুফ সহ হযরত ইয়াকূব আ. এর বারো জন পুত্র সন্তান ছিলেন। তাদের প্রত্যেকেরই অনেক সন্তান-সন্ততি হয় এবং বংশ বিস্তার লাভ করে।



ইউসুফ আ. এর পরিচয়


হযরত ইয়াকূব আ. এর উপাধি ছিল ইসরাঈল। তাই সেই বারটি পরিবার সবাই ‘বনী ইসরাঈল’ নামে পরিচিত হয়। বারো ছেলের মধ্যে দশজন বড়ছেলে হযরত ইয়াকূব আ. এর প্রথমা স্ত্রী লাইয়্যা বিনতে লাইয়্যানের গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মৃত্যুর পর ইয়াকূব আ. লাইয়্যার বোন রাহীলকে বিবাহ করেন। রাহীলের গর্ভে দুই ছেলে ইউসুফ ও বিনয়ামীন জন্মগ্রহণ করেন। 


তাই হযরত ইউসুফ আ. এর একমাত্র সহোদর ভাই ছিলেন বিনয়ামীন এবং অবশিষ্ট দশজন বৈমাত্রেয় ভাই। এরপর ইউসুফ আ. এর আম্মা রাহীলও বিনয়ামীনের জন্মের সময় মৃত্যুমুখে পতিত হন। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন লিল কুরতুবী)




দীনের দাওয়াত নিয়ে ফেরাউনের দরবারে মুসা ‘আলাইহিস সালাম

 দীনের দাওয়াত নিয়ে ফেরাউনের দরবারে মুসা ‘আলাইহিস সালাম


নবুওয়্যাত প্রাপ্তির পর মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার বড় ভাই হযরত হারুন ‘আলাইহিস সালাম, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের পক্ষ থেকে মিসর সম্রাট ফেরাউনকে ঈমান ও দীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য আদিষ্ট হন।


এই মর্মে আল্লাহ তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে তাদের দাওয়াতের মূলনীতি শিখিয়ে দিলেন, 


اذْهَبَا ۤاِلٰى فِرْعَوْنَ اِنَّهٗ طَغٰى○  فَقُوْلَا لَهٗ قَوْلًا لَّيِّنًا لَّعَلَّهٗ يَتَذَكَّرُ اَوْ يَخْشٰى ○


অর্থঃ আপনারা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যান। সে খুব অহংকারী হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আপনারা তাকে নম্র কথা বলুন। হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৪৪)


এখানে বলা হয়েছে, প্রতিপক্ষ যতই অবাধ্য এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস ও গলদ চিন্তাধারার অধিকারী হোক না কেন, তার সাথেও সংস্কার ও পথপ্রদর্শনের কর্তব্য পালনকারীদের হিতাকাঙ্ক্ষীর ভঙ্গিতে নম্রভাবে বিনয়ের সাথে কথাবার্তা বলতে হবে। এরই ফলে সে কিছু চিন্তাভাবনা করতে পারে এবং তার অন্তরে আল্লাহ তা‘আলার ভয় সৃষ্টি হতে পারে।


তখন হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম হারুন ‘আলাইহিস সালামকে নিয়ে আল্লাহ তা‘আলার আদেশ মোতাবেক ফেরাউনের কাছে গেলেন এবং তাকে ঈমানের দাওয়াত দিলেন আর বনী ইসরাইল সম্প্রদায়কে হিদায়াত করে দীনের পথে আনার উদ্দেশ্যে তাদের অন্যায় দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে তার সাথে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানালেন। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


وَقَالَ مُوْسٰى يَا فِرْعَوْنُ اِنِّىْ رَسُوْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعَالَمِيْنَ ○ حَقِيْقٌ عَلٰى ۤاَنْ لَا اَقُوْلَ عَلَى اللّٰهِ اِلَّا الْحَقَّ قَدْ جِئْتُكُمْ بِبَيِّنَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ فَاَرْسِلْ مَعِىَ بَنِىۤ اِسْرَائِٓيْلَ ○


অর্থঃ হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম বললেন, হে ফেরাউন, আমি বিশ্বপালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত রাসূল। আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি সুদৃঢ়। আমি আপনার নিকট প্রতিপালকের স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছি। সুতরাং আপনি বনী ইসরাইলদের আমার সাথে পাঠিয়ে দিন। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৪-১০৫)


ফেরাউন হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের দাওয়াতের জবাবে বললো, 


قَالَ فَمَن رَّبُّكُمَا يَا مُوْسٰى


অর্থঃ  সে বললো, তা হলে কে তোমাদের রব হে মুসা?


এর উত্তরে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম বললেন, 


قَالَ رَبُّنَا الَّذِىْ اَعْطَىٰ كُلَّ شَىْءٍ خَلْقَهٗ ثُمَّ هَدٰى


অর্থঃ তিনি বললেন, আমাদের রব সেই মহান সত্তা, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার উপযুক্ত গঠন দান করেছেন। অতঃপর তাকে পথপ্রদর্শন করেছেন। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৪৯-৫০)


এই আয়াত দিয়ে বুঝা যায়, মুসা ‘আলাইহিস সালাম ফেরাউনকে সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘আলার ঐ মহান গুণের কথা বলেছেন, যা সমগ্র সৃষ্টজগতে পরিব্যাপ্ত এবং কেউ এই গুণের কাজটি নিজে অথবা অন্য কোনো মানব করেছে বলে দাবি করতে পারে না।


ফলে ফেরাউন এই কথার কোন জবাব দিতে পারলো না। সে লা-জবাব হয়ে আবোল-তাবোল প্রশ্ন তুলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল এবং শেষে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে এমন একটি প্রশ্ন করলো, যার সত্যিকার জবাব সাধারণ মানুষ শুনতে পেলে, মুসা ‘আলাইহিস সালামের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে এবং তাদের শ্রদ্ধা ভক্তিও তাঁর প্রতি নষ্ট হয়ে যাবে। প্রশ্নটি হলো, 


قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُوْنِ الْاُوْلٰى


অর্থঃ সে (ফেরাউন) বললো, তা হলে পূর্ববর্তী কালের লোকদের অবস্থা কি? (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৫১)


অর্থাৎ অতীত যুগে যেসব ব্যক্তি ও জাতি প্রতিমাপূজা করতো, তোমার মতে তারা কিরূপ? তাদের শেষ পরিণাম কী হয়েছে?


ফেরাউনের উদ্দেশ্য ছিল, এর উত্তরে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম অবশ্যই বলবেন, তারা সবাই গোমরাহ ও জাহান্নামী। তখন ফেরাউন একথা বলার সুযোগ পাবে, তুমি তো গোটা বিশ্বকেই বেওকুফ, গোমরাহ ও জাহান্নামী মনে করো। এ কথা শুনে জনসাধারণের, মুসা ‘আলাইহিস সালামের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি নষ্ট হয়ে যাবে এবং কুধারণা পোষণ করবে। ফলে ফেরাউনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়ে যাবে।


কিন্তু মুসা ‘আলাইহিস সালাম বিচক্ষনতার সাথে এই প্রশ্নের এমন সুন্দর জবাব দিলেন, যার ফলে ফেরাউনের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে গেল। নিচের এই আয়াতে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের সেই জবাবের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে, 


قَالَ عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّىْ فِىْ كِتَابٍ لَا يَضِلُّ رَبِّىْ وَلَا يَنْسٰى


অর্থঃ মুসা ‘আলাইহিস সালাম বললেন, তাদের খবর আমার পালনকর্তার কাছে আমলনামায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। আমার রব বিভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃত হন না। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৫২)



ফেরাউন ও তার কওমের নাফরমানীর শাস্তি

 ফেরাউন ও তার কওমের নাফরমানীর শাস্তি


আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


ثُمَّ بَعَثْنَا مِنْ بَعْدِهِمْ مُّوسٰى بِاٰيَاتِنَا اِلٰى فِرْعَوْنَ وَمَلَئِه فَظَلَمُوْا بِهَا فَانظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِيْنَ○ وَقَالَ مُوْسٰى يَا فِرْعَوْنُ اِنِّىْ رَسُوْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعَالَمِيْنَ○ حَقِيْقٌ عَلٰى اَنْ لَّاۤ اَقُوْلَ عَلَى اللّٰهِ اِلَّا الْحَقَّ قَدْ جِئْتُكُمْ بِبَيِّنَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ فَاَرْسِلْ مَعِىَ بَنِىْۤ اِسْرَآئِيْلَ، قَالَ اِنْ كُنْتَ جِئْتَ بِاٰيَةٍ فَاْتِ بِهَا ۤاِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ○ فَاَلْقٰى عَصَاهُ فَاِذَا هِىَ ثُعْبَانٌ مُّبِيْنٌ○ وَنَزَعَ يَدَهٗ فَاِذَا هِىَ بَيْضَاءُ لِلنَّاظِرِيْنَ○


অর্থঃ অতঃপর আমি তাদের পরে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে পাঠালাম নিদর্শনাবলীসহ ফেরাউন ও তার সভাসদদের নিকট। তখন তারা সেই নিদর্শনাবলীর সাথে কুফরী করলো। সুতরাং লক্ষ্য করো, কী পরিণতি হয়েছে অনাচারীদের। মুসা ‘আলাইহিস সালাম বললেন, হে ফেরাউন, আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তার পক্ষ থেকে একজন রাসূল। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি সুদৃঢ়। আমি তোমাদের নিকট প্রতিপালকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে এসেছি। সুতরাং তুমি বনী ইসরাইলকে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও। সে (ফেরাউন) বললো, যদি তুমি কোন নিদর্শন নিয়ে এসে থাকো, তবে তা উপস্থিত করো, যদি তুমি সত্যবাদী হয়ে থাকো। তখন তিনি তার লাঠি নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জ্যান্ত এক অজগর হয়ে গেল। তিনি তার হাত বের করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা দর্শকদের চোখে ধবধবে উজ্জ্বল শুভ্রে পরিণত হলো। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৩-১০৮)


আয়াতে “তাদের পরে” বলে হযরত নূহ, হুদ, সালেহ, লূত ও শু‘আইব ‘আলাইহিমুস সালামের পরে অথবা তাঁদের এই সম্প্রদায়ের পরে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের আগমন তাদের পরে হয়েছিল। আয়াতে যে বলা হয়েছে, “আমি মুসাকে আমার নিদর্শনসহ ফেরাউন ও তার জাতির প্রতি পাঠিয়েছি”, এখানে নিদর্শন দিয়ে আসমানী কিতাব তাওরাতও হতে পারে কিংবা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুজিযাসমূহও হতে পারে।

ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের নাম ও বংশপরিচয়

 ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের নাম ও বংশপরিচয়


আল্লাহ তা‘আলার বিশিষ্ট নবী ও রাসূল হযরত ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের বংশপরম্পরা হচ্ছে- ইবরাহীম বিন তারেখ বিন নাহুর বিন সারুগ বিন রাগাও বিন ফালেগ বিন আবের বিন সালেহ বিন আর বিন সাম বিন নূহ ‘আলাইহিমুস সালাম।


ইবনে আসাকির রহ. বলেন, ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের মাতার নাম উমায়লা। কালবী বলেন, তার মাতার নাম বুনা বিনতে কুরবাতা বিন কুরাসি। তিনি বনী আরফাখাস বিন সাম বিন নূহ গোত্রের ছিলেন। (কাসাসূল আম্বিয়া, ২০২ পৃষ্ঠা) 


এতে দেখা যাচ্ছে, ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম পিতা ও মাতা উভয়দিক দিয়েই নূহ ‘আলাইহিস সালামের বংশধর ছিলেন।


ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের পিতার নাম “আযর” বলে প্রসিদ্ধ রয়েছে। অধিকাংশ ইতিহাসবিদ বলেন, তার নাম তারেখ; আযর তার উপাধি।


তবে ইমাম রাযীসহ পূর্ববর্তী কোন কোন আলেম বলেন, ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের পিতার নাম “তারেখ” এবং চাচার নাম আযর। তার চাচা আযর নমরূদের মন্ত্রিত্ব লাভের পর মুশরীক হয়ে যায়। আর চাচাকে পিতা বলা আরবী বাকরীতিতে সাধারণভাবে প্রচলিত। এই রীতি অনুযায়ী আয়াতে আযরকে ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালামের পিতা বলে অভিহিত করা হয়েছে। (যুরকানী ও শরহে মাওয়াহিব)


ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম দামেস্ক শহরে বারযা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেছেন। অবশ্য প্রসিদ্ধ হলো, তিনি বাবেল শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন।

যেভাবে মূর্তিপূজার সূচনা হলো

 যেভাবে মূর্তিপূজার সূচনা হলো


হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামের কওমের মূর্তিপূজার সূচনার ঘটনা হলো, তারা পরস্পরে এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিল যে, আমরা আমাদের দেব-দেবী, বিশেষত নিম্নোক্ত এই পাঁচ প্রতিমার উপাসনা ত্যাগ করবো না। ১. ওয়াদ্দ (وَدٌّ)। ২. সুওয়া (سُوَاعٌ)। ৩. ইয়াগুস (يَغُوْثُ)। ৪. ইয়াউক (يَعُوْقُ)। ৫. নাসর (نَسْرٌ)।


ইমাম বাগাবী রহ. বর্ণনা করেন, এই পাঁচজন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার নেক ও খাস বান্দা ছিলেন। তাদের সময়কাল ছিল হযরত আদম ও হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামের যমানার মাঝামাঝি। তাদের অনেক ভক্ত ও অনুসারী ছিল। তাদের ইন্তেকালের পর তাদের অনুসারীরা লম্বা সময় পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও হুকুম-আহকামের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত রাখে।


অতঃপর এক সময় শয়তান তাদের এই বলে প্ররোচিত করলো, তোমরা যেসব নেক বান্দার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইবাদত করো, যদি তাদের মূর্তি তৈরি করে সামনে রেখে নিতে পারো, তা হলে তোমাদের উপাসনা পূর্ণতা লাভ করবে এবং বিনয় ও একাগ্রতা অর্জিত হবে। তারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মূর্তি তৈরি করে ইবাদতখানা তৈরী করলো এবং তাদেরকে স্মরণ করে ইবাদতে বিশেষ আনন্দ অনুভব করতে লাগল।


এই অবস্থায়ই তাদের সবাই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলো। তারা অবশ্য ঐসব মূর্তি বা প্রতিমার কখনোই পূজা করতো না। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ নতুন এক বংশধর তাদের জায়গায় এলো। তারা এগুলোর হাকিকত জানতো না।


এবার শয়তান এসে এই নতুন প্রজন্মকে বুঝাল, তোমাদের পূর্বপুরুষদের খোদা ও উপাস্য ছিল মূর্তি ও প্রতিমা। তারা দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবীর লক্ষ্যে এসব মূর্তি ও প্রতিমারই উপাসনা করতো। তখন নতুন প্রজন্ম শয়তানের এসব কথা বিশ্বাস করলো এবং সেসব মূর্তি ও প্রতিমার পূজা শুরু করলো। তখন থেকেই পৃথিবীতে প্রতিমাপূজার সূচনা ঘটল।


সর্বপ্রথম মূর্তিপূজারি জাতি

 সর্বপ্রথম মূর্তিপূজারি জাতি


উল্লিখিত আয়াতসমূহে হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামের উম্মতের অবস্থা ও নূহ ‘আলাইহিস সালামের সাথে তাদের সংলাপের কথা বর্ণনা করা হয়েছে।


নবী-আগমনের ধারাবাহিকতায় হযরত আদম ‘আলাইহিস সালাম যদিও সর্বপ্রথম নবী, কিন্তু তার আমলে ঈমানের সাথে কুফর ও গোমরাহীর মোকাবেলার পর্যায় ছিল না। এ ব্যাপারে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বর্ণনায় এক হাদীসে এসেছে 


كَانَ بَيْنَ اٰدَمَ وَنُوْحٍ عَشَرَةُ قُرُوْنٍ كُلُّهُمْ عَلَى الْإِسْلَامِ.


অর্থঃ আদম ‘আলাইহিস সালাম ও নূহ ‘আলাইহিস সালামের মাঝখানে এমন দশ শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে, যাদের সকলেই তাওহীদে বিশ্বাসী ছিল।


বস্তুত পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম নূহ ‘আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ই মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়। তাই তার যামানা থেকেই ঈমান ও কুফরের সাথে মোকাবেলার পর্যায় আসে। নিম্নোক্ত আয়াতে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে, 


کَانَ النَّاسُ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً ۟ فَبَعَثَ اللهُ النَّبِیّٖنَ مُبَشِّرِیْنَ وَمُنْذِرِیْنَ ۪ وَ اَنْزَلَ مَعَهُمُ الْکِتٰبَ بِالْحَقِّ لِیَحْكُمَ بَیْنَ النَّاسِ فِیْمَا اخْتَلَفُوْا فِیْهِ 


অর্থঃ সকল মানুষ একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা পয়গামবর পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী হিসাবে। আর তাদের সাথে অবতীর্ণ করলেন সত্য কিতাব। যাতে মানুষের মাঝে বিতর্কমূলক বিষয়ে মীমাংসা করতে পারেন। (সূরা বাকারা, আয়াত: ২১৩)


বলা হয়, হযরত আদম ‘আলাইহিস সালামের শরী‘আতের অধিকাংশ বিধানই পৃথিবী আবাদকরণ ও মানবীয় প্রয়োজনাদির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। কুফর বা কাফেরদের তখন অস্তিত্ব ছিল না। কুফর ও শিরকের সাথে ঈমানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামের আমল থেকেই শুরু হয়।


আর রিসালাত ও শরী‘আতের দিক দিয়ে হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামই জগতের প্রথম রাসূল। এ ব্যাপারে মুসলিম শরীফের শাফা‘আত অধ্যায়ে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত লম্বা এক হাদীসে হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামকে সর্বপ্রথম রাসূল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, 


يَا نُوْحُ أَنْتَ أَوَّلُ الرُّسُلِ إلَى الْأَرْضِ 


অর্থঃ হে নূহ, আপনি ভূপৃষ্ঠের সর্বপ্রথম রাসূল।


এ ছাড়া মহাপ্লাবনে সারা পৃথিবী ডুবে যাওয়ার পর যারা প্রাণে বেঁচে ছিল, তারা ছিল হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালাম ও তার নৌকায় অবস্থিত সঙ্গী-সাথী। তাদের দিয়েই পৃথিবী নতুনভাবে আবাদ হয়েছে। এ কারণেই হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামকে “ছোট আদম” বলা হয়। আর তাই তো পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত আয়াতসমূহে পয়গামবরগণের কাহিনী বর্ণনার সূচনা তার দিয়েই করা হয়েছে।


এই কাহিনীতে সাড়ে নয়শ বছরের সুলম্বা হায়াতে হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামের নবীসুলভ চেষ্টা-প্রচেষ্টা, উম্মতের বিরুদ্ধাচরণ এবং পরিণতিতে গুটিকতক ঈমানদার ছাড়া অবশিষ্ট সবার প্লাবনে ডুবে যাওয়ার বিষয় বর্ণিত হয়েছে। এর বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপঃ


হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালাম হযরত আদম ‘আলাইহিস সালামের অষ্টমপুরুষ। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি হযরত আদম ‘আলাইহিস সালামের পুত্র হযরত শীস ‘আলাইহিস সালামের বংশধর ছিলেন। হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামের আসল নাম “শাকির”। কোন কোন রেওয়ায়াতে “সাকান” এবং কোন কোন বর্ণনায় “আবদুল গাফফার” নাম বর্ণিত হয়েছে।


এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায় যে, হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালামের যুগটি হযরত ইদরীস ‘আলাইহিস সালামের আগে ছিল না, বরং পরে ছিলো। তবে অধিকাংশ সাহাবীর মতে, হযরত নূহ ‘আলাইহিস সালাম ইদরীস ‘আলাইহিস সালামের আগে ছিলেন। (আল বাহরুল মুহীত)


মুসতাদরাকে হাকিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নূহ ‘আলাইহিস সালাম চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়্যাতপ্রাপ্ত হন এবং প্লাবনের পর ষাট বছর জীবিত ছিলেন।


নূহ ‘আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় ইরাকে বসবাসরত ছিল এবং তারা বাহ্যত সভ্য জাতি হলেও তারাই পৃথিবীতে মূর্তিপূজার সূচনা ও প্রচলন ঘটিয়েছিল।

হযরত আদম আঃ এর সৃষ্টি

 Adam A. Its creation


باسمه تعالى


Allah Ta'ala says, 


وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَاٍ مَّسْنُوْنٍ ○وَالْجَاۤنَّ خَلَقْنٰهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ نَّارِ السَّمُوْمِ ○وَ اِذْ قَالَ رَبُّکَ لِلْمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیْ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنْ صَلْصَالٍ مِّنْ حَمَاٍ مَّسْنُوْنٍ ○ فَاِذَا سَوَّیْتُهٗ وَنَفَخْتُ فِیْهِ مِنْ رُّوْحِیْ فَقَعُوْا لَهٗ سٰجِدِیْنَ ○فَسَجَدَ الْمَلٰٓئِکَۃُ كُلُّهُمْ اَجْمَعُوْنَ ○ اِلَّاۤ اِبْلِیْسَ ؕ اَبٰۤی اَنْ يَّكُوْنَ مَعَ السّٰجِدِیْنَ○


Meaning: Verily I created man from fragrant dry clay and before that I created jinn from hot fire. Remember, when your Lord said to the angels, I am creating man from the dry clay of fragrant weeping. Then when I formed him properly and infused him with spirit from Me, the angels prostrated themselves before him. Then the angels all prostrated together; But except for Iblis, he refused to join the group of prostraters. (Surah Hijr, verses 26-31) 


Allah Ta'ala created Hazrat Adam 'alayhis salam from clay. Before his leaven was ready, Allah Ta'ala told the angels that He would create a creature from the soil, which would be called "Bashar" (man) and that creature would have the honor of representing Allah on earth.


In this context, Allama Bagavi. Narrated, Allah Ta'ala first created the heavens and the earth, the angels and the jinn. And commanded the angels to live in the heavens and the jinn in the earth. Then the jinns lived on earth for a long time.


Then, instead of worshiping Allah, hatred and violence spread among them. They started fighting and killing each other.


Then Allah Ta'ala sent a group of angels to the earth to free the earth from those rioters. Those angels were also called jinn according to many. They were the maintainers of Paradise. Their name was Jin. Their leader was Iblis. He was their leader and wisest of all.


By the order of Allah Ta'ala, those angels came to the earth and drove the jinn to the mountains and forests and started living on earth themselves. Allah made the worship of Allah light on them.


Allah Ta'ala gave Iblis the responsibility of ruling the earth and the heavens near it and maintaining Paradise. So he used to worship Allah sometimes on earth, sometimes in heaven and sometimes in heaven.


Due to this high status, Iblis became arrogant. He said to himself, the reason why Allah Ta'ala gave me this kingdom and dignity is that I am the leader and teacher of all the angels.


Before creating the first human Adam 'alayhis salam, Allah Ta'ala addressed the angels and said,

 اِنِّىْ جَعاِلٌ فِى الْاَرْضِ خَلِيْفَةً 

That is, I am creating representatives on earth.


Allama Bagavi Rah. It can be understood from its description that Iblis was an angel. Allah Ta'ala says,

فَسَجَدَ الْمَلٰئِكَةُ كُلُّهُمْ اَجْمَعُوْنَ اِلَّاۤ اِبْلِيْسَ

Meaning: All the angels prostrated together except Iblis.


This is also understood from the Istisna (اِسْتِثْنَا) of this verse. Because, if they do not join the group, why istisna (separation) from them?


However, Hazrat Hasan Basri. Narrated on the basis of Sahih traditions, Iblis was originally from the jinn. He became a great believer in the conversation of the angels and he used to live together with the angels. That is why Hazrat Adam 'alayhis salam was ordered to prostrate himself. Apart from this, the opinion of Hazrat Hasan Basri is proved to be strong with another verse of the Holy Quran and various authentic hadiths.


When Allah Ta'ala ordered Iblis and the angels to prostrate to Adam 'alayhis salam, Iblis refused to do so out of arrogance.


আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান

 ১. আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান


আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান আনার অর্থ এ কথা বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। তাঁর কোন প্রকার অংশ বা অংশীদার বা শরীক নেই, তাঁর কোন কিছুর অভাব নেই। তিনিই সকলের সব অভাব পূরণকারী। তিনি কারো পিতা নন, পুত্রও নন, তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। একমাত্র তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা। কোন জ্ঞান বা চক্ষু আল্লাহ তা‘আলাকে আয়ত্ত করতে পারে না। তিনি চিরকাল আছেন এবং থাকবেন। তিনি অনাদি ও অনন্ত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া আর কোন মা’বুদ নাই। তিনিই একমাত্র ইবাদত পাওয়ার যোগ্য। 


সারকথা, আল্লাহ তা‘আলার বিষয়ে তিনটি কথা অবশ্যই মানতে হবে। 


ক. তিনি এক, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় । তাঁর কোন শরীক নেই। সৃষ্ট জীবের সাথে তাঁর কোন তুলনা হয় না। 


খ. তাঁর অনেকগুলো অনাদি-অনন্ত সিফাত বা গুণ আছে, সেগুলো একমাত্র তাঁর জন্যেই নির্ধারিত। সেসব গুনের মধ্যে অন্য কেউ শরীক নেই। যেমন: তিনিই সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, হায়াত-মওতদাতা, বিধানদাতা, গায়েব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। তিনি চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই। অন্য সবকিছুই ক্ষয়শীল ও ধ্বংসশীল, কিন্তু তাঁর ক্ষয়ও নেই, ধ্বংসও নেই। সবকিছুর ওপর তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত। সবকিছুর ওপরই তাঁর ক্ষমতা চলে। আল্লাহ তা‘আলা কারো মুখাপেক্ষী নন, সব-ই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি আগুণকে পানি এবং পানিকে আগুণ করতে পারেন। এই যে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আকাশ, বাতাস, চন্দ্র সূর্য ইত্যাদি বিদ্যমান, তিনি হুকুম করলে মুহূর্তের মধ্যে এসব নিস্তনাবুদ হয়ে যাবে। তিনি সর্বজ্ঞ, তিনি না জানেন-এমন কিছুই নেই। মনের মধ্যে যে ভাবনা বা কল্পনা উদয় হয়, তাও তিনি জানেন। তিনি সবকিছুই দেখছেন। সবকিছুই শুনছেন। মৃদু আওয়াজ এমনকি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ আওয়াজও তিনি শুনেন। গাইবের বিষয় একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। তিনি ছাড়া আর কেউ গাইব জানেন না। এমনকি নবী-রাসূল অলী ও নন। আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র হাযির-নাযির। তিনি ছাড়া আর কেউ হাযির নাযির নন। এমনকি নবী-অলীগণ ও নন। 


তিনি যা ইচ্ছা, তা-ই করতে পারেন। কোন পীর, ওলী, পয়গাম্বর বা ফেরেশতা তাঁর ইচ্ছাকে রদ বা প্রতিহত করতে পারে না। তিনি আদেশ ও নিষেধ জারি করেন। 


তিনি একমাত্র বন্দেগীর উপযুক্ত। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য হতে পারে না। অন্য কারো ইবাদত-বন্দেগী করা যায় না। তাঁর কোন অংশীদার কিংবা সহকর্মী বা উযীর-নাযীর নেই। তিনি একক কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনিই সর্বোপরি বাদশাহ, রাজাধিরাজ; সবই তাঁর বান্দা ও গোলাম । তিনি বান্দাদের ওপর বড়ই মেহেরবান। 


তিনি সব দোষ-ত্রুটি হতে পবিত্র। তাঁর মাঝে আদৌ কোন রকমের দোষ-ত্রুটি নেই। তাঁর ক্রিয়া-কর্ম, আদেশ-নিষেধ সবই ভালো ও মঙ্গলময়, কোন একটিতেও বিন্দুমাত্র অন্যায় বা দোষ নেই। তিনিই বিপদ-আপদ দেন এবং বিপদ-আপদ হতে উদ্ধার করেন, অন্য কেউ কোন প্রকার বিপদ-আপদ হতে মুক্তি দিতে পারে না। 


প্রকৃত সম্মান ও মর্যাদা তাঁরই। তিনিই সকল সম্মান ও মর্যাদার অধিপতি। তিনিই প্রকৃত মহান। একমাত্র তিনিই নিজেকে নিজে বড় বলতে পারেন। এতদ্ব্যতীত অন্য কারো এ রকম বলার ক্ষমতা ও অধিকার নেই। তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, এবং সৃষ্টি করবেন। তিনি এমন দয়ালু যে, দয়া করে অনেকের গুনাহ তিনি মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল।


তিনি অত্যন্ত পরাক্রমশালী। তাঁর প্রভাব ও প্রভুত্ব সকলের ওপর; কিন্তু তাঁর ওপর কারো প্রভাব বা প্রভুত্ব চলে না।


তিনি বড়ই দাতা। সমস্ত জীবের ও যাবতীয় চেতন-অচেতন পদার্থের আহার তিনি দান করেন। তিনি রুযীর মালিক। রুযী কমানো-বাড়ানো তাঁরই হাতে। তিনি যার রুযী কমাতে ইচ্ছা করেন, তার রুযী কম করে দেন। যার রুযী বাড়াতে ইচ্ছা করেন, বাড়িয়ে দেন। 


কাউকে উচ্চপদস্থ বা অপদস্থ করার ক্ষমতা তাঁরই হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন, আবার যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন। এসবই তাঁরই ক্ষমতায়, তাঁরই ইখতিয়ারে। অন্য কারো এতে কোন রকম ক্ষমতা বা অধিকার নেই। তিনি প্রত্যেকের যোগ্যতা অনুসারে যার জন্যে যা ভালো মনে করেন, তার জন্যে তাই ব্যবস্থা করেন। তাতে কারো কোন প্রকার প্রতিবাদ করার অধিকার নেই। 


তিনি ন্যায়পরায়ণ, তাঁর কোন কাজেই অন্যায় বা অত্যাচারের লেশমাত্র নেই। তিনি বড় সহিষ্ণু, অনেক কিছু সহ্য করেন। কত পাপিষ্ঠ তাঁর নাফরমানী করছে, তাঁর ওপর কত রকম দোষারোপ এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ পর্যন্ত করছে, তারপরও তিনি তাদের রিযিক জারি রেখেছেন। 


তিনি এমনই কদরশিনাস-গুণগ্রাহী এবং উদার যে, তাঁর আদৌ কোন প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও মানুষ তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করলে এবং তাঁর আদেশ পালন করলে, তিনি তার বড়ই কদর করেন এবং সন্তুষ্ট হয়ে আশাতীত রূপে পুরস্কার দান করেন। তিনি এমনই মেহেরবান ও দয়ালু যে, তাঁর নিকট দরখাস্ত করলে [অর্থাৎ দু‘আ করলে] তিনি তা মঞ্জুর করেন। তাঁর ভাণ্ডার অফুরন্ত, তাঁর ভাণ্ডারে কোন কিছুরই অভাব নেই। তিনি অনাদি -অনন্তকাল ব্যাপী সকল জীব-জন্তু ও প্রাণিজগতের আহার যোগান দিয়ে আসছেন।


তিনি জীবন দান করেছেন, ধন-রত্ন দান করছেন, বিদ্যা-বুদ্ধি দান করেছেন। অধিকন্তু আখিরাতেও অসংখ্য ও অগণিত সাওয়াব ও নেয়ামত দান করবেন। কিন্তু তাঁর ভাণ্ডার তবুও বিন্দুমাত্র কমেনি বা কমবে না। 


তাঁর কোন কাজই হিকমত ও মঙ্গল ছাড়া নয়। কিন্তু সব বিষয় সকলের বুঝে আসে না। তাই নির্বুদ্ধিতা বশত কখনো না বুঝে দিলে দিলে বা মুখে প্রতিবাদ করে ঈমান নষ্ট করা উচিত নয়। তিনি সব কর্ম সমাধানকারী। বান্দা চেষ্টা করবে, কিন্তু সে কর্ম সমাধানের ভার তাঁরই কুদরতী হাতে ন্যস্ত।


তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং কিয়ামতের দিন পুনর্বার সকলকে জীবিত করবেন। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দেন। তাঁর হাকীকত ও স্বরূপ এবং তিনি যে কত অসীম, তা কারো বোঝার ক্ষমতা নেই। কেবলমাত্র তাঁর সিফাত অর্থাৎ গুণাবলী ও তাঁর কার্যাবলীর দ্বারাই তাকে আমরা চিনতে পারি। 


মানুষ পাপ করে যদি খাঁটিভাবে তাওবা করে, তবে তিনি তা কবুল করেন। যে শাস্তির উপযুক্ত, তাকে তিনি শাস্তি দেন। তিনি হিদায়াত দেন। তাঁর নিদ্রা নেই। সমস্ত বিশ্বজগতের রক্ষণাবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে তিনি বিন্দুমাত্রও ক্লান্ত হন না। তিনিই সমস্ত বিশ্বের রক্ষক।


এ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলাকে চিনবার জন্যে তাঁর কতগুলো সিফাতে কামালিয়া অর্থাৎ মহৎ গুণাবলীর বর্ণনা দেওয়া হলো। এতদ্ব্যতীত যত মহৎ গুণ আছে, আল্লাহ তা‘আলা তৎসমুদয় দ্বারা বিভূষিত। ফলকথা এই যে, সৎ ও মহৎ যত গুণ আছে, অনাদিকাল যাবৎ সে সব আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে আছে এবং চিরকাল থাকবে। কিন্তু কোন দোষ ত্রুটির লেশমাত্রও তাঁর মধ্যে নেই। 


আল্লাহ তা‘আলার গুণ সম্বন্ধে কুরআন মজীদে এবং হাদীস শরীফের কোন কোন জায়গায় এরূপ উল্লেখ আছে যে, তিনি আশ্চর্যান্বিত হন, হাসেন, কথা বলেন, দেখেন, শুনেন, সিংহাসনাসীন হন, নিম্ন আসমানে অবতীর্ণ হন। তাঁর হাত, পা, মুখ ইত্যাদি আছে। এসব ব্যাপারে কখনো বিভ্রান্তিতে পড়তে বা তর্ক-বিতর্ক করতে নেই। সহজ-সরলভাবে আমাদের আক্বীদা ও একীন এই রাখা উচিত যে, আমাদের বা অন্য কোন সৃষ্টজীবের মতো তাঁর ওঠা-বসা বা হাত-পা তো নিশ্চয়ই নয়। তবে কেমন? তা আমাদের জ্ঞানের বাইরে। প্রিয় ভ্রাতৃবৃন্দ! সাবধান! সাবধান!!! যেন শয়তান ধোঁকা দিয়ে গোলকধাঁধায় না ফেলতে পারে। একিনী আক্বীদা ও অটল বিশ্বাস রাখবেন যে, আমাদের বা অন্য কোন সৃষ্ঠজীবের সাদৃশ্য হতে আল্লাহ তা‘আলা সম্পূর্ণ পবিত্র ও মহান। 


এ দুনিয়াতে জাগ্রত অবস্থায় চর্ম চোখে কেউ আল্লাহ তা‘আলাকে দেখতে পারেনি। কখনো পারবেও না। তবে জান্নাতে গিয়ে জান্নাতীরা আল্লাহ পাকের দীদার লাভ  করবে। জান্নাতে এটাই-সর্বোৎকৃষ্ট নেয়ামত হবে। 


গ. একমাত্র তিনিই মাখলুকের ইবাদত-বন্দেগী পাওয়ার উপযুক্ত। আর কেউ ইবাদত পাওয়ার উপযুক্ত নয়। 


আল্লাহ তা’লার ওপর ঈমান আনার অর্থ শুধু আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্ব স্বীকার করা নয়; বরং অস্তিত্ব স্বীকার করার সাথে সাথে তার উপরোক্ত গুণবাচক কথাগুলো স্বীকার করাও জরুরী। নতুবা আল্লাহপাকের ওপর সম্পূর্ণরূপে ঈমান আনা হবে না এবং সে ঈমান গ্রহণযোগ্যও হবে না। 


আল্লাহর সিফাতী বা গুণবাচক ৯৯টি নাম 

১. الرحمن অত্যন্ত দয়াবান।

২. الرحيم পরম দয়ালু।

৩. الملك  অধিপতি।

৪. القدوس পবিত্র।

৫. السلام শান্তিময়।

৬. المؤمن নিরাপত্তা বিধায়ক।

৭. المهيمن রক্ষক।

৮. العزيز পরাক্রমশালী।

৯. الجبار শক্তি প্রয়োগে সংশোধনকারী, প্রবল।

১০. المتكبر মহিমান্বিত।

১১. الخالق স্রষ্টা।

১২. البارئ উদ্ভাবনকর্তা, ত্রুটিহীন স্রষ্টা।

১৩. المصور আকৃতিদাতা।

১৪. الغفار পরম ক্ষমাশীল।

১৫. القهار মহা পরাক্রান্ত।

১৬. الوهاب মহা দাতা।

১৭. الرزاق রিযিকদাতা।

১৮. الفتاح মহা বিজয়ী।

১৯. العليم মহাজ্ঞানী।

২০. القابض সংকোচনকারী।

২১. الباسط সম্প্রসারণকারী।

২২. الخافض পতনকারী, অবনমনকারী।

২৩. الرافع উন্নয়নকারী।

২৫. المذل অপমানকারী।

২৬. السميع সর্বশ্রোতা।

২৭. البصير সম্যক দ্রষ্টা।

২৮. الحكم মীমাংসাকারী।

২৯. العدل ন্যায়নিষ্ঠ।

৩০. اللطيف সুক্ষ্মদর্শী।

৩১. الخبير সর্বজ্ঞ।

৩২. الحليم ধৈর্যশীল।

৩৩. العظيم মহিমাময়।

৩৪. الغفور পরম ক্ষমাকারী।

৩৫. الشكور গুণগ্রাহী।

৩৬. العلي সর্বোচ্চ সমাসীন, অতি উচ্চ।

৩৭. الكبير সুমহান।

৩৮. الحفيظ মহারক্ষক।

৩৯. المقيت আহার্যদাতা।

৪০. الحسيب হিসাব গ্রহণকারী।

৪১. الجليل মহিমান্বিত। 

৪২. الكريم অনুগ্রহকারী।

৪৩. الرقيب পর্যবেক্ষণকারী।

৪৪. المجيب কবুলকারী।

৪৫. الواسع সর্বব্যাপী।

৪৬. الحكيم প্রজ্ঞাময়।

৪৭. الودود প্রেমময়।

৪৮. المجيد গৌরবময়।

৪৯. الباعث পুনরুত্থানকারী।

৫০. الشهيد প্রত্যক্ষকারী।

৫১. الحق সত্যপ্রকাশক, হক।

৫২. الوكيل কর্ম বিধায়ক।

৫৩. القوى শক্তিশালী।

৫৪. المتين দৃঢ়তাসম্পন্ন।

৫৫. الولي অভিভাবক।

৫৬. الحميد প্রশংসিত।

৫৭. المحصى হিসাব গ্রহণকারী।

৫৮. المبدئ আদি স্রষ্টা।

৫৯. المعيد পুন:সৃষ্টিকারী।

৬০. المحيي জীবনদাতা।

৬১. المميت মৃত্যুদাতা।

৬২. الحي চিরঞ্জীব।

৬৩. القيوم স্বপ্রতিষ্ঠ সংরক্ষণকারী।

৬৪. الواجد প্রাপক, তিনি যা চান তাই পান।

৬৫. الماجد মহান।

৬৬. الواحد একক।

৬৭. الاحد এক অদ্বিতীয়।

৬৮. الصمد অনপেক্ষ।

৬৯.  القادر শক্তিশালী।

৭০. مقتدر ক্ষমতাশালী।

৭১.  المقدم অগ্রবর্তীকারী।

৭২.المؤخر পশ্চাদবর্তীকারী।

৭৩. الأول  সর্বপ্রথম অর্থাৎ অনাদি।

৭৪. الآخر শেষ অর্থাৎ অনন্ত।

৭৫. الظاهر প্রকাশ্য।

৭৬.الباطن গুপ্তসত্তা।

৭৭. الوالي অধিপতি।

৭৮. المتعال সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।

৭৯. البر কৃপাময়।

৮০. التواب তওবা কবুলকারী।

৮১.   المنتقم শাস্তিদাতা।

৮২.  العفو ক্ষমাকারী।

৮৩. الرؤوف দয়ার্দ্র।

৮৪. مالك الملك সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।

৮৫. ذو الجلال و الإكرام মহিমাময় মহানুভব।

৮৬. المقسط ন্যায়পরায়ণ।

৮৭. الجامع একত্রকরণকারী।

৮৮. الغني অভাবমুক্ত।

৮৯. المغني অভাব মোচনকারী।

৯০. المانع প্রতিরোধকারী।

৯১. الضار ক্ষতির ক্ষমতাকারী।

৯২. النافع কল্যাণকারী।

৯৩. النور জ্যোতির্ময়।

৯৪. الهادي পথ প্রদর্শক।

৯৫. البديع নমুনাবিহীন সৃষ্টিকারী।

৯৬. الباقي চিরস্থায়ী।

৯৭. الوارث স্বত্বাধিকারী।

৯৮. الرشيد সত্যদর্শী।

৯৯. الصبور ধৈর্যশীল।  


পবিত্র কুরআনুল কারীমে এবং হাদীস গ্রন্থসমূহে এসবের বাইরেও আরো কিছু গুণবাচক নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন:

১.اَلرَّبُّ প্রতিপালক।

২.اَلْمُنْعِمُ নিয়ামতদানকারী।

৩.اَلْمُعْطيْ দাতা।

৪.اَلصَّادِقُ সত্যবাদী।

৫.اَسَّتَّارُ গোপনকারী।


আল আসমাউল হুসনার যথাযথ বাংলা অনুবাদ কিছুতেই হয় না। এখানে যে বাংলা অর্থ দেওয়া হয়েছে, তা কেবল ইঙ্গিত মাত্র। আল আসমাউল হুসনার মধ্যে থেকে কিছু সংখ্যক গুণাবলী আল্লাহর জন্য সত্তাগত, অনাদি অনন্ত, ব্যাপক ও অসীম। আর মানুষের জন্য এ সকল গুণ কেবল আল্লাহর দেয়া অস্থায়ী এবং সীমিত।