ইউসুফ আ. কে হত্যার পরিকল্পনা
পরামর্শের এক পর্যায়ে তাদের একজন এ মত পেশ করলো যে, ইউসুফকে হত্যা করা হোক। অন্য একজন বললো, তাকে হত্যা না করে কোনো দূরদেশে ফেলে আসা হোক। এতে করে মাঝখান থেকে এ কাঁটা দূর হয়ে যাবে এবং পিতার সব মনোযোগ আমাদের প্রতিই নিবদ্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তাকে হত্যা কিংবা দেশান্তরের কারণে যে গুনাহ হবে, তার প্রতিকার এই যে, পরবর্তীকালে তাওবা করে আমরা ভালো হয়ে যাবো। শিরোনামে উল্লিখিত “এবং তারপর ভালো হয়ে যাবো” বাক্যের এক অর্থ তা-ই বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফকে হত্যা করার পর আমাদের অবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। কেননা, তখন পিতার মনোযোগের কেন্দ্র শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং মনোযোগ আমাদের দিকেই নিবদ্ধ হবে এবং আমরা ভালো পরিগণিত হবো।
সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যেরই একজন সমস্ত কথাবার্তা শুনে বললো, ইউসুফকে হত্যা করা উচিৎ হবে না। বরং যদি কিছু করতেই হয়, তবে তাকে কূপের গভীরে এমন জায়গায় নিক্ষেপ করা হোক, যেখানে সে জীবিত থাকবে এবং পথিক যখন কূপে আসবে, তখন তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। এভাবে একদিকে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে এবং চিন্তা করতে হবে না। বরং এমতাবস্থায় কোন পথিকই তাকে দূরদেশে নিয়ে চলে যাবে।
এ অভিমত প্রকাশকারী ছিলো তাদের বড় ভাই ইয়াহুদা। কোন কোন রিওয়ায়েতে আছে যে, সবার মধ্যে রুবীল ছিল বড়। সে-ই এ অভিমত ব্যক্ত করছিল। এ ব্যক্তি সম্পর্কে সামনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিসরে যখন ইউসুফ আ. এর ছোট ভাই বিনয়ামীনকে আটক করা হয়, তখন সে বলেছিলো, আমি ফিরে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবো? তাই আমি আর কেনানে ফিরে যাবো না।
পরিকল্পনার বাস্তবায়ন
হযরত ইউসুফ আ. এর ভায়েরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পিতার কাছে এভাবে আবেদন পেশ করলো যে, আব্বাজান! ব্যাপার কী! আপনি দেখি ইউসুফ সম্পর্কে আমাদের প্রতি আস্থা রাখেন না! অথচ আমরা তার পুরোপুরি হিতাকাঙ্ক্ষী। আগামীকাল আপনি তাকে আমাদের সাথে ভ্রমণে পাঠিয়ে দিন, যাতে সেও স্বাধীনভাবে পানাহার ও খেলাধুলা করতে পারে। আমরা সবাই তার পুরোপুরি দেখাশোনা করবো।
তাদের এ আবেদন থেকেই বোঝা যায় যে, এর আগেও তারা কোনো সময় এ ধরনের আবেদন করেছিল, যা পিতা অগ্রাহ্য করেছিলেন। যদ্দরূণ এবার কিঞ্চিত জোর ও পীড়াপীড়ি সহকারে পিতাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ আবেদন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,
قَالُوْا یٰۤاَبَانَا مَا لَکَ لَا تَاْمَنَّا عَلٰی یُوْسُفَ وَ اِنَّا لَهٗ لَنٰصِحُوْنَ○ اَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًا یَّرْتَعْ وَیَلْعَبْ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ○
অর্থঃ তারা বললো, হে আমাদের আব্বা! আপনার কী হয়েছে যে, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশ্বাস করেন না? অথচ আমরা তো তার শুভাকাঙ্ক্ষী। আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে প্রেরণ করুন। তাহলে সে তৃপ্তিসহ খাবে এবং খেলাধুলা করবে, আর আমরা অবশ্যই তার হিফাযত করবো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১১-১২)
ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা যখন আগামীকাল ইউসুফকে তাদের সাথে ভ্রমণে পাঠানোর আবেদন করলো, তখন হযরত ইয়াকূব আ. বললেন, তাকে পাঠানো আমি দু’কারণে পছন্দ করি না। প্রথমতঃ সে নয়নের মণি, আমার সামনে না থাকলে, আমি শান্তি পাই না। দ্বিতীয়তঃ আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, জঙ্গলে তোমাদের অসাবধানতার মুহূর্তে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলতে পারে।
ইয়াকূব আ. এর এ বক্তব্য কালামে পাকের এ আয়াতে বিবৃত হয়েছে,
قَالَ اِنِّیْ لَیَحْزُنُنِیْۤ اَنْ تَذْهَبُوْا بِهٖ وَ اَخَافُ اَنْ یَّاْكُلَهُ الذِّئْبُ وَاَنْتُمْ عَنْهُ غٰفِلُوْنَ○
অর্থঃ ইয়াকূব আ. বললেন, আমার দুশ্চিন্তা হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশঙ্কা করি যে, বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে, অথচ তোমরা তার থেকে অমনোযোগী থাকবে। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৩)
বাঘের আশঙ্কা হওয়ার কারণ এই যে, তখন কেনানে বাঘের খুব উপদ্রব ছিল। ওদিকে হযরত ইয়াকূব আ. স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি পাহাড়ের উপর আছেন। নীচে পাহাড়ের পাদদেশে ইউসুফ আ.। হঠাৎ দশটি বাঘ এসে তাঁকে ঘেরাও করে ফেলে এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু সেগুলোর মধ্য থেকে একটি বাঘ এসে তাঁকে মুক্ত করে দেয়, অতঃপর ইউসুফ আ. মাটির অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেন।
এর ব্যাখ্যা এভাবে প্রকাশ পায় যে, দশটি বাঘ ছিল দশজন ভাই এবং যে বাঘটি তাঁকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে, সে ছিল বড় ভাই ইয়াহুদা অথবা রুবীল। আর মাটির অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেয়ার অর্থ, কূপের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ স্বপ্নের ভিত্তিতে হযরত ইয়াকূব আ. স্বয়ং এ ভাইদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন এবং তাদরকেই বাঘ বলেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে ওদের কাছে কথা প্রকাশ করেননি। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন লিল কুরতুবী)
ভাইয়েরা হযরত ইয়াকূব আ. এর এ কথা শুনে বললো, আপনার এ ভয়-ভীতি অমূলক। আমরা দশজনের শক্তিশালী দল তার হেফাজাতের জন্য বিদ্যমান রয়েছি। আমাদের সবার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘেই তাকে খেয়ে ফেলে, তাহলে আমাদের অস্তিত্বই নিষ্ফল হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় আমাদের দিয়ে কোন্ কাজের আশা করা যেতে পারে?
নিম্নোলিখিত আয়াতে ইউসুফ আ. এর ভোইদের সেই কথা বর্ণনা করা হয়েছে,
قَالُوْا لَئِنْ اَکَلَهُ الذِّئْبُ وَنَحْنُ عُصْبَۃٌ اِنَّاۤ اِذًا لَّخٰسِرُوْنَ○
অর্থঃ তারা বললো, আমরা একটি ভারী দল থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘ তাকে খেয়ে ফেলে, তবে তো আমরা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৪)
হযরত ইয়াকূব আ. পয়গাম্বরসুলভ গাম্ভীর্যের কারণে ছেলেদের সামনে এ কথা প্রকাশ করলেন না যে, আমি স্বয়ং তোমাদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করি। কারণ এতে প্রথমতঃ তাদের মনোকষ্ট হতো, দ্বিতীয়তঃ পিতার এরূপ বলার দিয়ে ভাইদের শত্রুতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে এখন ছেড়ে দিলেও অন্য কোনো সময় কোনো ছলছুতায় তাঁকে হত্যা করার ফিকিরে থাকতো। তাই তিনি তাঁকে নিয়ে যাবার অনুমতি দিয়ে দিলেন। তবে ভাইদের কাছ থেকে অঙ্গীকারও নিয়ে নিলেন, যাতে ইউসুফের কোনো রকম কষ্ট না হয়। এ পর্যায়ে বিশেষ করে বড় ভাই ইয়াহুদার হাতে তাকে সোপর্দ করে বললেন, তুমি তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও অন্যান্য প্রয়োজনের ব্যাপারে খেয়াল রাখবে এবং শীঘ্র ফিরিয়ে আনবে।
ভাইরা পিতার সামনে ইউসুফকে কাঁধে তুলে নিলো এবং পালাক্রমে সবাই উঠাতে লাগলো। কিছু দূর পর্যন্ত হযরত ইয়াকূর আ. ও তাদেরকে বিদায় জানানোর জন্যে গেলেন।
ইমাম কুরতুবী রহ. ঐতিহাসিক রিওয়ায়েতের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, তারা যখন হযরত ইয়াকূব আ. এর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, তখন তারা ইউসুফ আ. কে নামিয়ে দিল এবং তিনি পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। কিন্তু অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে তাদের সাথে সাথে চলতে অক্ষম হচ্ছিলেন আবার তাকে হত্যা করার ব্যাপারে ভাইদের পরামর্শও টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি এক ভাইয়ের আশ্রয় নিতে চাইলেন। সে কোনোরূপ সহানুভূতি প্রদর্শন না করায় তৃতীয়, চতুর্থ; এমনিভাবে প্রত্যেক ভাইয়ের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু সবাই উত্তর দিল যে, তুই যে এগারোটি নক্ষত্র এবং চাঁদ ও সূর্য তোকে সিজদা করতে দেখেছিস, তাদেরকে ডাক দে, তারাই তোকে সাহায্য করবে, আমরা তোকে সাহায্য করতে পারবো না।
ইমাম কুরতুবী রহ. এর ভিত্তিতে বলেন যে, এ থেকে বোঝা যায় ভাইয়ের কোনো না কোনো উপায়ে ইউসুফ আ. এর স্বপ্নের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। সে স্বপ্ন ইউসুফ আ. এর প্রতি তাদের তীব্র ক্রোধ ও কঠোর ব্যবহারের কারণ হয়েছিল। উক্ত স্বপ্নের কারণেই তারা ইউসুফ আ. এর সাথে হিংসাত্মক আচরণ করেছিল।
অবশেষে ইউসুফ আ. ইয়াহুদাকে বললেন, আপনি সবার বড়। আপনিই আমার দুর্বলতা ও অল্পবয়স্কতা এবং পিতার মনোকষ্টের কথা চিন্তা করে দয়ার্দ্র হোন। আপনি ঐ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করুন যা পিতার সাথে করেছিলেন। একথা শুনে ইয়াহুদার মনে দয়ার সঞ্চার হলো এবং তাকে বললো, যতক্ষণ আমি জীবিত আছি, এসব ভাই তোমাকে কোনো কষ্ট দিতে পারবে না।
তখন ইয়াহুদার অন্তরে আল্লাহ তা‘আলা দয়া ও ন্যায়ানুগ কাজ করার প্রেরণা জাগ্রত করে দিলেন। সে অন্যান্য ভাইকে সম্বোধন করে বললো, নিরপরাধকে হত্যা করা মহাপাপ। আল্লাহকে ভয় করো এবং বালকটিকে তার পিতার কাছে নিয়ে চলো। তবে তার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে নাও যে, সে পিতার কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করবে না। ভাইয়ের উত্তর দিল, আমরা জানি, তোমার উদ্দেশ্য কী? তুমি পিতার অন্তরে নিজের মর্যাদার আসন সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও। মনে রাখো, যদি তুমি আমাদের ইচ্ছা পূরণে প্রতিবন্ধক হও, তবে আমরা তোমাকেও হত্যা করবো।
ইয়াহুদা দেখলো যে, নয় ভাইয়ের বিপরীতে সে একা কিছু করতে পারবে না। তাই সে বললো, তোমরা যদি এ বালককে নিপাত করতে মনস্থ করে থাকো, তবে আমার কথা শোনো, নিকটেই একটি প্রাচীন কূপ রয়েছে। এতে অনেক ঝোপ-জঙ্গল গজিয়েছে। সাপ, বিচ্ছু ও হরেক রকমের ইতর প্রাণী এখানে বাস করে। তোমরা তাকে সেই কূপে ফেলে দাও। যদি কোনো সাপ ইত্যাদি তাকে দংশন করে শেষ করে দেয়, তবে তোমাদের উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে এবং নিজ হাতে হত্যা করার দোষ থেকে তোমরা মুক্ত থাকবে। পক্ষান্তরে যদি সে জীবিত থাকে, তবে হয়তো কোনো কাফেলা এখানে আসবে এবং পানির জন্য কূপে বালতি ফেলবে। ফলে সে বের হয়ে আসবে। আর তারা তাকে সাথে করে অন্য কোনো দেশে পৌঁছে দেবে। এমতাবস্থায়ও তোমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে।
ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ
এ প্রস্তাবে ভাইয়েরা সবাই একমত হলো। তাদের এ বিষয়টি নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে,
فَلَمَّا ذَهَبُوْا بِهٖ وَ اَجْمَعُوْۤا اَنْ یَّجْعَلُوْهُ فِیْ غَیٰبَتِ الْجُبِّ ۚ وَ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمْ بِاَمْرِهِمْ هٰذَا وَهُمْ لَا یَشْعُرُوْنَ○
অর্থঃ অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে চললো, এবং অন্ধকার কূপের গভীরে নিক্ষেপ করতে একমত হলো, তখন আমি তাকে ওহী দিয়ে জানিয়ে দিলাম যে, অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কাজের কথা এক সময় স্মরণ করিয়ে দিবে, আর তারা তখন তোমার উঁচু মর্যাদার কারণে তোমাকে চিনবে না। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৫)
ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এ ওহী সম্পর্কে দু প্রকার ব্যাখ্যা থেকে পারে। (এক) কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাঁর সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদ দানের জন্য এ ওহী পাঠানো হয়েছিল। (দুই) কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে ইউসুফ আ. কে ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী জানিয়ে দিয়েছিলেন। এতে আরো বলে দিয়েছিলেন যে, তুমি এভাবে ধ্বংস হওয়ার কবল থেকে মুক্ত থাকবে এবং এমন পরিস্থিতি দেখা দিবে যে, তুমি তাদের তিরস্কার করার সুযোগ পাবে। অথচ তারা ধারণা করবে না যে, তুমিই তাদের ভাই ইউসুফ। কারণ, তখন তুমি অনেক উচ্চ মর্যাদায় অবস্থান করবে। এক পর্যায়ে তারা হযরত ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলো। তখন তিনি কূপের প্রাচীর জড়িয়ে ধরলেন। ভাইয়েরা তাঁর জামা খুলে তা দিয়ে তাঁর হাত বাঁধলো। তখন ইউসুফ আ. পুনরায় তাদের কাছে দয়া ভিক্ষা চাইলেন। কিন্তু তখনও তারা আগের মতো সেই উত্তরই দিল যে, যে এগারোটি নক্ষত্র তোকে সিজদা করেছিল, তাদেরকে ডাক দে। তারাই তোকে সাহায্য করবে। অতঃপর ভাইয়েরা তাকে বালতিতে ভরে কূপে ছাড়তে লাগলো। সেটা মাঝপথে যেতেই উপর থেকে রশি কেটে দিল।
আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং ইউসুফ আ. কে হিফাযত করলেন। যদ্দরূণ পানিতে পড়ার কারণে তিনি কোনোরূপ আঘাত পেলেন না। অতঃপর নিকটেই একখণ্ড ভাসমান প্রস্তর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি সুস্থ ও বহাল তবিয়তে তার উপরে বসে রইলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে যে, জিবরাঈল আ. আল্লাহ পাকের আদেশ পেয়ে তাঁকে প্রস্তর খণ্ডের উপর বসিয়ে দেন। ইউসুফ আ. তিন দিন কূপে অবস্থান করেন। ইয়াহুদা প্রত্যহ গোপনে তাঁর জন্য কিছু খাদ্য আনতো এবং বালতির সাহায্যে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতো। ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ করার পর তাঁর ভাইয়েরা সন্ধ্যা বেলায় কান্না করতে করতে তাদের পিতার নিকট উপস্থিত হলো। বিষয়টিকে নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে,
وَجَآءُوْۤا اَبَاهُمْ عِشَآءً یَّبْكُوْنَ○
অর্থঃ আর তারা রাতের অন্ধকারে কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এলো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৬)
হযরত ইয়াকূব আ. কান্নার শব্দ শুনে বাইরে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী! তোমাদের ছাগল পালের উপর কেউ আক্রমণ করেনি তো? ইউসুফ কোথায়? তখন ভাইয়েরা যা বললো, তা পবিত্র কুরআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে,
قَالُوْا یٰۤاَبَانَاۤ اِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا یُوْسُفَ عِنْدَ مَتَاعِنَا فَاَکَلَهُ الذِّئْبُ ۚ وَمَاۤ اَنْتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صٰدِقِیْنَ○
অর্থঃ তারা বললো, হে আমাদের আব্বা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের আসবাবপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। তখন তাকে নেকড়ে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না; যদিও আমরা সত্যবাদী হই। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৭)
ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা তাঁর জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে এনেছিল, যাতে পিতার মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, বাঘই তাঁকে খেয়ে ফেলেছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ প্রতারণার কথা এভাবে বিবৃত হয়েছে,
وَجَآءُوْ عَلٰی قَمِیْصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ
অর্থঃ তারা ইউসুফের জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে আনলো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮)
কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের মিথ্যা ফাঁস করে দেয়ার জন্য তাদেরকে একটি জরুরী বিষয় থেকে গাফেল করে দিয়েছিলেন। তারা যদি রক্ত লাগানোর সাথে সাথে জামাটিও ছিন্ন করে দিত, তবে তারা ইউসুফকে বাঘে খাওয়ার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করতে পারতো। কিন্তু তারা অক্ষত জামায় ছাগল ছানার রক্ত মাখিয়ে পিতাকে ধোঁকা দিতে চাইলো। ইয়াকূব আ. অক্ষত জামা দেখে বললেন, বাছারা! এ বাঘ কেমন বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিল যে, ইউসুফকে তো খেয়ে ফেলেছে; কিন্তু জামার কোনো অংশ ছিন্ন হতে দেয়নি!
এভাবে হযরত ইয়াকূব আ. এর কাছে তাদের জালিয়াতি ফাঁস হয়ে গেলে তিনি যা বললেন, তা কুরআন মাজীদের ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে
وَجَآءُوْ عَلٰی قَمِیْصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ اَنْفُسُكُمْ اَمْرًا ؕ فَصَبْرٌ جَمِیْلٌ ؕ وَاللهُ الْمُسْتَعَانُ عَلٰی مَا تَصِفُوْنَ○
অর্থঃ ইয়াকূব আ. বললেন, (এটা কারণই নয়;) বরং তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা কথা সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখন পূর্ণ ধৈর্য্য ধারণ করাই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছো, সে সম্বন্ধে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮)
গভীর কূপ থেকে মুক্তি
ওদিকে আল্লাহর মেহেরবানীতে একটি কাফেলা সেই অন্ধকার কূপের কাছে এসে উপস্থিত হয়। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে, এ কাফেলা সিরিয়া থেকে মিসর যাচ্ছিল। পথ ভুলে এ জনমানবহীন জঙ্গলে এসে পড়েছে। তারা পানি সংগ্রহকারীদেরকে পানি খোঁজার জন্য কূপে প্রেরণ করলো। মিসরীয় কাফেলার পথ ভুলে এখানে পৌঁছা এবং এই অন্ধকারকূপের সম্মুখীন হওয়া সাধারণ দৃষ্টিতে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। কিন্তু যারা সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে ভালো জানেন, তারা জানেন যে, এসব ঘটনা একটি অপরটির সাথে পরস্পর সংযুক্ত ও অটুট ব্যবস্থাপনার মিলিত অংশ। হযরত ইউসুফ আ. এর স্রষ্টা ও রক্ষকই কাফেলাকে তাদের গন্তব্যের পথ থেকে সরিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন এবং ইউসুফকে সাহায্য করার জন্য কাফেলার লোকদেরকে এই অন্ধকার কূপে প্রেরণ করেছেন।
পানি আনার জন্য কাফেলার মালিক ইবনে দোবর নামক জনৈক ব্যক্তি সেই কূপে পৌঁছেন এবং বালতি নিক্ষেপ করলেন। ইউসুফ আ. সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য প্রত্যক্ষ করে বালতির রশি শক্ত করে ধরলেন। পানির পরিবর্তে বালতির সাথে একটি সমুজ্জ্বল মুখমণ্ডল পানি উত্তোলনকারীর দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো। পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে সে কথা ব্যক্ত করা হয়েছে,
وَجَآءَتْ سَیَّارَۃٌ فَاَرْسَلُوْا وَارِدَهُمْ فَاَدْلٰی دَلْوَهٗ ؕ قَالَ یٰبُشْرٰی هٰذَا غُلٰمٌ ؕ وَاَسَرُّوْهُ بِضَاعَۃً ؕ وَاللهُ عَلِیْمٌۢ بِمَا یَعْمَلُوْنَ○
অর্থঃ একটি কাফেলা এলো। অতঃপর তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করলো। সে নিজের বালতি ফেললো। বললো, কী আনন্দের কথা! এ তো একটি কিশোর! (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৯)
অপ্রত্যাশিতভাবে কূপের তলদেশ থেকে ভেসে ওঠা এই অল্প বয়স্ক অপরূপ ও বুদ্ধিদীপ্ত বালককে দেখে মালেক ইবনে দোবর চিৎকার করে উঠলেন। মুসলিম শরীফে মিরাজ রজনীর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ইউসুফ আ. এর সাথে সাক্ষাতের পর দেখলাম যে, আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র বিশ্বের রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেক তাঁকে দান করেছেন এবং অবশিষ্ট অর্ধেক সমগ্র বিশ্বে বণ্টন করা হয়েছে।
কাফেলার লোকেরা তখন তাঁকে একটি মূল্যবান পণ্য মনে করে গোপন করে ফেললো। আয়াতের পরবর্তী অংশে সে কথা বলা হয়েছে,
وَاَسَرُّوْهُ بِضَاعَۃً ؕ
অর্থঃ তারা ব্যাবসায়িক পণ্যরূপে তাকে গোপন করে ফেললো।
শুরুতে তো মালেক ইবনে দোবর এ কিশোরকে দেখে অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। কিন্তু পরে চিন্তাভাবনা করে স্থির করলেন যে, এটা জানাজানি না হওয়া উচিত এবং গোপন করে ফেলা দরকার, যাতে একে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ লাভ করা যায়।
অথবা এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা ঐ মুহূর্তে সেখানে এসেছিল। তারা বাস্তব ঘটনা গোপন করে তাঁকে পণ্যদ্রব্য করে নিলো। যেমন, কোনো কোনো রিওয়ায়েতে আছে যে, ইয়াহুদা প্রত্যহ ইউসুফ আ. কে কূপের মধ্যে খানা পৌঁছানোর জন্য যেতো। তৃতীয় দিন তাঁকে কূপের মধ্যে না পেয়ে সে ফিরে এসে ভাইদের কাছে ঘটনা বর্ণনা করলো। অতঃপর সকল ভাই একত্রে সেখানে পৌঁছলো এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর কাফেলার লোকদের কাছ থেকে ইউসুফকে বের করলো। তখন তারা বললো, এ বালকটি আমাদের গোলাম, পলায়ন করে এখানে এসেছে। তোমরা একে কবজায় নিয়ে খুব খারাপ কাজ করেছো।
একথা শুনে মালেক ইবনে দোবর ও তার সঙ্গীরা ভীত হয়ে গেল যে, তাদেরকে চোর সাব্যস্ত করা হবে। তাই ভাইদের সাথে তাকে ক্রয় করার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে লাগলো।
এমতাবস্থায় আয়াতের অর্থ এই হবে যে, ইউসুফের ভাইয়েরা, নিজেরাই ইউসুফকে পণ্যদ্রব্য স্থির করে বিক্রি করে দিলো। ইউসুফ আ. এর মতো একজন মহাপুরুষের সঠিক মূল্য সম্পর্কে ভাইয়েরা ছিল অজ্ঞ। আর তাছাড়া ইউসুফ আ. এর ভাইদের আসল উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন ছিল না। আসল উদ্দেশ্যতো ছিলো পিতার কাছ থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। তাই তারা তাঁকে গুটি কতেক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল।
নিম্নেবর্ণিত আয়াতে এ কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে,
وَشَرَوْهُ بِثَمَنٍۭ بَخْسٍ دَرَاهِمَ مَعْدُوْدَۃٍ ۚ وَکَانُوْا فِیْهِ مِنَ الزَّاهِدِیْنَ○
অর্থঃ তারা তাকে বিক্রি করে দিল অতি অল্পমূল্যে-গুণাগুণিত কয়েক দিরহামে। আর তারা ছিল তাঁর ব্যাপারে নিরাসক্ত। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২০)
কাফেলার লোকেরা তাঁকে মিসর নিয়ে গেলেন। সেখানে নেয়ার পর ইউসুফ আ. কে বিক্রয়ের কথা ঘোষণা করতেই ক্রেতারা প্রতিযোগিতামূলক ভাবে দাম বলতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইউসুফ আ. এর ওজনের সমান স্বর্ণ, সমপরিমাণ মৃগনাভি ও সমপরিমাণ রেশমি বস্ত্র দাম সাব্যস্ত হলো।