Wednesday, March 22, 2023

জিন সম্বন্ধে আক্বীদা

 জিন সম্বন্ধে আক্বীদা


আরেক প্রকার জীবকে আল্লাহ তা‘আলা আগুনের দ্বারা সৃষ্টি করে আমাদের চক্ষুর অগোচর করে রেখেছেন। তাদেরকে জিন বলে। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ সবরকম হয়। তারা নারী-পুরুষও বটে এবং তাদের সন্তানাদিও হয়। তাদের খানা-পিনার প্রয়োজনও হয়। জিন মানুষের ওপর আছর করতে পারে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও বড় দুষ্ট হচ্ছে ‘ইবলিশ শয়তান’। হাশরের ময়দানে জিনদেরও হিসাব-নিকাশ হবে। এ কথা কুরআনে কারীমে উল্লেখ আছে। সুতরাং তা বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ।

Tuesday, March 21, 2023

পুরো নামাযের ৬ মাসায়িল

 পুরো নামাযের ৬ মাসায়িল


১. নামাযের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অন্তরে নামাযের খেয়াল রাখা, আর সহজ পদ্ধতি হল সব কিছু খেয়াল করে পড়া। মুখস্থের জোরে না পড়া। (মন অন্য কোন দিকে চলে গেলে, স্মরণ হওয়া মাত্রই ফিরিয়ে আনা)


২. মাঝের তাকবীরগুলো পূর্ববর্তী রুকন থেকে আরম্ভ করে অপর রুকনে পৌঁছে শেষ করা। (কিন্তু তাকবীর এক আলিফ থেকে লম্বা করা যাবে না।) এর জন্য কোন মুহাক্বিক আলিম থেকে নামাযের বাস্তব প্রশিক্ষণ নেওয়া জরুরী।


৩. এক রুকন থেকে অন্য রুকনে যেতে বিলম্ব না করা। 


৪. পঠিত সূরা/ দু‘আ সমূহের প্রতি অন্তরে খেয়াল করা।


৫. হাই আসলে যথাসম্ভব মুখ বন্ধ রাখতে চেষ্টা করা।


৬. হাঁচি আসলে তা যথাসম্ভব দমিয়ে রাখা।


এ পর্যন্ত ‘পুরুষদের নামাযের ১০০ মাসায়িল’ পূর্ণ হল।

Saturday, March 18, 2023

নবী-রাসূল আ. এর ওপর ঈমান

 ৪. নবী-রাসূল আ. এর ওপর ঈমান


নবী-রাসূল আ.- এর ওপর ঈমান আনার অর্থ এ কথা বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের হিদায়াতের জন্যে এবং তাদেরকে সঠিক পথ দেখাবার জন্য স্বীয় বান্দাদের মধ্যে হতে বাছাই করে বহুসংখ্যক পয়গাম্বর অর্থাৎ নবী-রাসূল আ. মনোনীত করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যাতে করে মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করে দুনিয়াতে কামিয়াব হতে পারে এবং পরকালে দোযখ থেকে মুক্তি লাভ করে বেহেশত হাসিল করতে পারে।


পয়গাম্বরগণ সকলেই মাসুম বা নিষ্পাপ। তাঁরা কোন প্রকার পাপ করেন না। নবীগণ মানুষ। তাঁরা খোদা নন। খোদার পুত্র নন। খোদার রূপান্তর (অবতার) নন। বরং তাঁরা হলেন আল্লাহর প্রতিনিধি। নবীগণ আল্লাহর বাণী হুবহু পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের সঠিক সংখ্যা কুরআন শরীফ বা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীস শরীফে বর্ণনা করেন নি। কাজেই নিশ্চিতভাবে তাঁদের সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারে না। এ কথা যদি ও প্রসিদ্ধ যে, এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন কিন্তু কোন সহীহ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত নয়। শুধু এতটুকু বলা যায় যে, বহুসংখ্যক পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন।


আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে তাঁদের দ্বারা অনেক অসাধারণ ও অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ঐ সব ঘটনাকে মু‘জিযা বলে। নবীগণের মু‘জিযাসমূহ বিশ্বাস করাও ঈমানের অঙ্গ। 


পয়গাম্বরগণের আ. মধ্যে সর্বপ্রথম দুনিয়াতে আগমন করেছেন হযরত আদম আ. এবং সর্বশেষ অথচ সর্বপ্রধান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতাবা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর পরে অন্য কেউ দুনিয়াতে নবী বা রাসূল হিসেবে আগমন করেননি এবং করবেনও না। হযরত ঈসা আ. কিয়ামতের পূর্বে যদিও আগমন করবেন, কিন্তু তিনি তো পূর্বেই নবী ছিলেন। নতুন নবী হিসেবে তিনি আগমন করবেন না। আমদের নবী খাতামুন নাবিয়্যীন বা শেষনবী। তাঁর পরে নতুনভাবে আর কোন নবী আসবেন না; তারপর আসল বা ছায়া কোনরূপ নবীই নাই। বরং তাঁর আগমনের মাধ্যমে নবুওয়াতের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের নবীর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে যত জিন বা ইনসান ছিল, আছে বা সৃষ্টি হবে, সকলের জন্যেই তিনি নবী। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবীতে একমাত্র তাঁরই হুকুম এবং তরীকা সকলের মুক্তি ও নাজাতের জন্যে অদ্বিতীয় পথ হিসেবে বহাল থাকবে। অন্য কোন ধর্ম, তরীকা বা ইজম এর অনুসরণ কাউকে আল্লাহর দরবারে কামিয়াব করতে পারবে না। আমাদের নবীর পরে অন্য কেউ নবী হয়েছেন বা নবী হবেন বলে বিশ্বাস করলে তার ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। তেমনিভাবে কেউ নতুন নবী হওয়ার দাবি করলে বা তার অনুসরণ করলে, সেও কাফির বলে গণ্য হবে। 


হযরত ঈসা আ. এখনও আসমানে জীবিত আছেন। তাঁকে জীবিত অবস্থায় আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন, ইহা সত্য। কুরআন হাদীসে প্রমাণিত। তাই ইহা বিশ্বাস করতে হবে, অন্যথায় ঈমান থাকবে না, তিনি কিয়ামতের পূর্বে আসমান থেকে জমিনে অবতরণ করবেন। আমাদের নবীর অনুসারী হয়ে। হযরত ঈসা আ.- এর ব্যাপারে পুত্রবাদ ও কর্তৃত্বদের বিশ্বাস কুফরী। 


দুনিয়াতে যত পয়গাম্বর এসেছেন, সকলেই আমাদের মাননীয় ও ভক্তির পাত্র। তাঁরা সকলেই আল্লাহর হুকুম প্রচার করেছেন। তাঁদের মধ্যে পরস্পরে কোন বিরোধ ছিল না। সকলেই পরস্পর ভাই ভাই ছিলেন। হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্য হিকমতের কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হুকুম জারি করেছেন। আর এই সামান্য বিভিন্নতাও শুধু আমলের ব্যাপারে, ঈমান আকীদার ব্যাপারে নয়। আকীদাসমূহ আদি হতে অন্ত পর্যন্ত চিরকাল এক। আক্বীদার মধ্যে কোন প্রকার রদবদল বা পরিবর্তন হয়নি, আর হবেও না কখনো। পয়গাম্বরগণ সকলেই কামিল ছিলেন। কেও নাকিস বা অসম্পূর্ণ ছিলেন না। অবশ্য তাঁদের মধ্যে কারো মর্যাদা ছিল বেশি, কারো মর্যাদা ছিল তুলনামূলকভাবে কম। সকল নবী নিজ নিজ কবরে জীবিত আছেন। এজন্য নবীগণকে ‘হায়াতুন্নবী’ বলা হয়।


উল্লেখ্য যে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্তবা সর্বাপেক্ষা বেশি। তাই বলে নবীগণের মধ্যে তুলনা করে একজনকে বড় এবং একজনকে হেয় বা ছোট করে দেখানো বা বর্ণনা করা নিষেধ। 


নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম-এর সমস্ত কথা মেনে নেয়া জরুরী। তাঁর একটি কথাও অবিশ্বাস করলে বা সে সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করলে কিংবা তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করলে বা দোষ বের করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়।


ঈমানের জন্যে আমাদের নবীর সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মি‘রাজ ভ্রমণের কথা বিশ্বাস করাও জরুরী। যে মি‘রাজ বিশ্বাস করে না, সে বেদ্বীন। তার ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। 


সাহাবীর পরিচিতিঃ

যেসব মুসলমান আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে স্বচক্ষে দেখেছেন, এবং ঈমানের হালতে ইনতিকাল করেছেন, তাঁদেরকে ‘সাহাবী’ বলা হয়। সাহাবীগণের অনেক ফযীলতের কথা কুরআন ও হাদীসে এসেছে। সমস্ত সাহাবী রা. গণের সাথে মুহাব্বত রাখা ও তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য। 


তাঁদের কাউকে মন্দ বলা আমদের জন্যে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। সাহাবীগণ যদিও মাসুম বা নিষ্পাপ নন, কিন্তু তাঁরা মাগফূর বা ক্ষমাপ্রাপ্ত। সুতরাং, পরবর্তী লোকদের জন্য তাঁদের সমালোচনা করার কোন অধিকার নেই। তাঁরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। 


তাঁরা সকলেই আদিল অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য সত্যবাদী এবং সত্যের মাপকাঠি। তাঁদের দোষ চর্চা করা হারাম এবং ঈমান বিধ্বংসী কাজ। ‘আকীদাতুত তাহাবী’ কিতাবে উল্লেখ আছে, ‘সাহাবীগণের প্রতি মুহাব্বত-ভক্তি রাখা দ্বীনদারী ও ঈমানদারী এবং দ্বীনের ও ঈমানের পূর্ণতা। আর তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা বা তাদের বিরূপ সমালোচনা করা কুফরী, মুনাফেকী এবং শরী‘আতের সীমার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।


সমস্ত সাহাবীগণের মাঝে চারজন সর্বপ্রধান। তাঁদের মধ্যে প্রথম হচ্ছেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা., তিনিই প্রথম খলীফা বরহক এবং তিনি সমস্ত উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক রা., তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান গণী রা. এবং চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা.। সকল সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার চির সন্তুষ্টির সুসংবাদ দিয়েছেন। বিশেষ করে মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন। এই দশজনকে আশারায়ে মুবাশশারা (সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন) বলা হয়। তাঁরা হলেন -১. হযরত আবু বকর রা., ২. হযরত ওমর ফারুক রা., ৩। হযরত উসমান রা. ৪. হযরত আলী রা., ৫. হযরত তালহা রা., ৬. হযরত যুবায়ের রা. ৭. হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা., ৮. হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াককাস রা., ৯. হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ রা., ১০. হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা.


নবী আ. এর বিবি ও আওলাদ সম্বন্ধে আক্বীদাঃ

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিবি ও আহল-আওলাদগণের রা. বিশেষভাবে তাযীম করা উম্মতের ওপর ওয়াজিব। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আওলাদগণের মধ্যে হযরত ফাতিমা রা. এবং বিবিগণের মধ্যে হযরত খাদীজা ও আয়িশা রা. এর মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। 


ওলী-বুযুর্গদের সম্বন্ধে আক্বীদাঃ

ওলী-বুযুর্গদের কারামত সত্য। কিন্তু ওলী-বুযুর্গগণ যত বড়ই হোন না কেন, তাঁরা নবী রাসূল আ. তো দূরের কথা, একজন সাধারণ সাহাবীর সমতুল্যও হতে পারেন না। অবশ্য হক্কানী পীর-মাশায়িখ ও উলামায়ে কিরাম যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়ারিশ এবং দ্বীনের ধারক বাহক সুতরাং, তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা রাখা, তাঁদের সঙ্গ লাভ করা এবং তাদের প্রতি বিদ্বেষ না রাখা সকল মুসলমানের জন্য জরুরী। দ্বীনের খাদিম হিসেবে তাঁদেরকে হেয় করা, কিংবা গালি দেয়া কুফরী কাজ। মানুষ যতই খোদার পেয়ারা হোক, হুঁশ-জ্ঞান থাকতে শরী‘আতের হুকুম-আহকামের পাবন্দী অবশ্যই তাকে করতে হবে। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত কখনো মাফ হবে না। তেমনিভাবে মদ খাওয়া, গান-বাদ্য করা, পরস্ত্রী দর্শন বা স্পর্শ করা কখনো তার জন্যে জায়িয হবে না। হারাম বস্তুসমূহ হারামই থাকবে এবং হারাম কাজ করে বা ফরয বন্দেগী ছেড়ে দিয়ে কেউ কখনো আল্লাহর ওলী হতে পারে না 

ফেরেশতাগণের ওপর ঈমান

 ২. ফেরেশতাগণের ওপর ঈমান


ফেরেশতাগণের ওপর ঈমান আনার অর্থ হলো এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ এক ধরণের মাখলুককে নূরের দ্বারা সৃষ্টি করে তাদেরকে আমাদের চক্ষুর অন্তরালে রেখেছেন। তাদেরকে ফেরেশতা বলে। তাঁরা পুরুষ বা মহিলা কোনটিই নন। বরং তাঁরা ভিন্ন ধরনের মাখলুক। অনেক ধরণের কাজ আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপর সোপর্দ করে রেখেছেন। যেমন: নবীগণের আ. নিকট অহী আনয়ন করা, মেঘ পরিচালনা করা, রুহু কবয করা, নেকী-বদী লিখে রাখা ইত্যাদি। তাঁরা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। তাঁরা বিন্দুমাত্র আল্লাহর নাফরমানী করেন না। তাঁরা আল্লাহর প্রিয় ও ফরমাবরদার বান্দা। তাঁদের মধ্যে চারজন ফেরেশতা যথা: হযরত জিবরাঈল আ. হযরত মীকাঈল আ., হযরত ইসরাফীল আ. ও হযরত আযরাঈল আ. অতিপ্রসিদ্ধ । 


জিন সম্বন্ধে আক্বীদা:

আরেক প্রকার জীবকে আল্লাহ তা‘আলা আগুনের দ্বারা সৃষ্টি করে আমাদের চক্ষুর অগোচর করে রেখেছেন। তাদেরকে জিন বলে। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ সবরকম হয়। তারা নারী-পুরুষও বটে এবং তাদের সন্তানাদিও হয়। তাদের খানা-পিনার প্রয়োজনও হয়। জিন মানুষের ওপর আছর করতে পারে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও বড় দুষ্ট হচ্ছে ‘ইবলিশ শয়তান’। হাশরের ময়দানে জিনদেরও হিসাব-নিকাশ হবে। এ কথা কুরআনে কারীমে উল্লেখ আছে। সুতরাং তা বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ।



Thursday, March 16, 2023

বেচা-কেনা ও লেন-দেন সংক্রান্ত কিছু হাদীস

 বেচা-কেনা ও লেন-দেন


বেচা-কেনা ও লেন-দেন সংক্রান্ত কিছু হাদীস

হারাম সম্পদ দিয়ে গঠিত শরীর দোযখে যাবে

হযরত জাবের রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’ব ইবনে উজরা রাযি. কে বলেছেন, হে কা‘ব ইবনে উজরা! যে দেহের গোশত হারাম মালে গঠিত, তা বেহেশতে প্রবেশ করবে না। হারাম মালে গঠিত দেহের জন্য দোযখই সমীচীন।

যে সুদ খায় এবং যে সুদ দেয় উভয়েই গুনাহগার

হযরত জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লা’নত করেছেন যে সুদ খায় তার প্রতি, যে সুদ দেয় তার প্রতি, যে সুদের দলীল লেখে তার প্রতি, যে দু’জন সুদের সাক্ষী হয় তাদের প্রতি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাও বলেছেন, গুনাহগার সাব্যস্ত হওয়ার ব্যাপারে সকলেই সমান।

একই বস্তু পরিমাপে কম-বেশি করা যাবে না

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, একদা হযরত বেলাল রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বরনী (এক প্রকার খুরমা) নিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই প্রকার খুরমা কোত্থেকে পেলে? তিনি বললেন, আমার কাছে নিম্নমানের খুরমা ছিলো। আমি দুই সা’ (প্রায় আট সের) নিম্নমানের খুরমা এক সা’ (প্রায় চার সের) ভালো খুরমার বিনিময়ে বিক্রি করেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খাওয়ানোর জন্য। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আহা! এ তো সুদী লেনদেন হয়ে গেল। আহা! এ তো সুদী লেনদেন হয়ে গেল। এমনটি করো না। বরং তুমি এই মন্দ খুরমা পরিমাণে বেশি দিয়ে কম পরিমাণে উত্তম খুরমা লাভ করতে চাইলে মুদ্রার বিনিময়ে মন্দ খুরমা ভিন্নভাবে বিক্রি করবে অর্থাৎ সম্পূর্ণ পৃথক দু‘টি বেচা-কেনা করবে। এরপর সেই মুদ্রা দিয়ে উত্তম খুরমা কিনবে।

ঋণগ্রহীতার কোন সুযোগ-সুবিধা ঋণদাতা নিতে পারবে না

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যদি কোন ব্যক্তিকে ধার দেয়, এরপর ধারগ্রহীতা ধারদাতাকে কোন হাদিয়া বা উপহার দেয়, তবে তা গ্রহণ করবে না। অথবা যদি গ্রহীতা ধারদাতাকে যানবাহনের উপর বসাতে চায়, তবে তার উপর বসবে না। অবশ্য যদি ধার নেয়ার পূর্ব থেকে তাদের মধ্যে এরূপ আচরণ প্রচলিত থাকে, তবে তা স্বতন্ত্র কথা।

ফল গাছে থাকতে বিক্রি নিষেধ

হযরত ইবনে উমর রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুযাবানার সূরতে ক্রয়-বিক্রয় থেকে নিষেধ করেছেন। মুযাবানা খেজুরের মধ্যে এভাবে করা হয় যে, বাগানের গাছে খেজুর রয়েছে। অনুমান করা যে, বৃক্ষ থেকে ছিন্ন করে শুকালে এতে কী পরিমাণ খুরমা হবে? ঐ পরিমাণ খুরমা প্রদান করে তার বিনিময়ে বৃক্ষের খেজুর বৃক্ষে রেখে ক্রয় করা। মুযাবানা আঙ্গুরের মধ্যে এভাবে করা হয় যে, গাছে আঙ্গুর রয়েছে। অনুমান করা যে, শুকালে কী পরিমাণ কিশমিশ হতে পারে? সে মতে মেপে ঐ পরিমাণ কিশমিশের বিনিময়ে গাছের আঙ্গুর ক্রয় করা। আর শস্যের মধ্যে এভাবে হয় যে, ক্ষেতে শস্য আছে। অনুমান করা যে, এতে খাদ্য কী পরিমাণ আছে? মেপে সে পরিমাণে ঐ জাতীয় খাদ্য প্রদান করে ক্ষেতের শস্য ক্রয় করা। এসব হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন।

গাছের ফল খাওয়ার উপযোগী না হলে বিক্রি করা নিষেধ

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাছের ফল উপযোগী হওয়ার আগে তা ক্রয়-বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন। এ নিষেধাজ্ঞা বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ের জন্য প্রযোজ্য।

সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন খেজুর বিক্রি করতে যতক্ষণ না তাতে লাল বা হলুদ রং আসে এবং গম-যব ইত্যাদি শিষ জাতীয় বস্তু যতক্ষণ পূর্ণ পেকে সাদা রংধারী না হয়ে যায় অর্থাৎ কোন প্রকার দুর্যোগে বিনষ্ট হওয়ার সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর বিক্রি করবে।

গাছের ফল লাল হওয়ার আগে বিক্রি নিষেধ

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন ফল লাল হওয়ার আগে বিক্রি করতে। তিনি বলেছেন, ফল পাকার আগে বিক্রি করার পর আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্ট কোন দুর্যোগে যদি ফল বিনষ্ট হয়ে যায়, তবে মুসলমান বিক্রেতা কিসের বিনিময়ে ক্রেতা থেকে টাকা আদায় করবে?

গাছের ফল অগ্রিম বিক্রি করা নিষেধ

হযরত জাবের রা, থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েক বছরের জন্য অগ্রিম ফল বিক্রি করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং তিনি পরামর্শ দিয়েছেন আহরণের আগে যা বিনষ্ট হয় তার মূল্য কর্তন করতে।

অনিশ্চিত বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় নিষেধ

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন বাই‘য়ে হাসাত (কাঁকর নিক্ষেপ করার মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয়) করা থেকে এবং বাই‘য়ে গারার (অনিশ্চিত বস্তুর ক্রয়-বিক্রয়) থেকে (যেমন পানির মধ্যে মাছ বিক্রি করা)।

যে বস্তু দখলে নেই তা বিক্রি করা নিষেধ

হযরত হাকীম ইবনে হিযাম রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে নিষেধ করেছেন ঐ বস্তু বিক্রি করতে যা আমার দখলে বা মালিকানায় নেই।

ত্রুটিপূর্ণ বস্তুর ত্রুটি গোপন রেখে বিক্রি নিষেধ

হযরত ওয়াসেলা ইবনে আসকা’ রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি কোন ত্রুটিপূর্ণ বস্তুর ত্রুটি না জানিয়ে বিক্রি করবে, সে সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টিতে নিমজ্জিত থাকবে এবং ফেরেশতাগণ তার প্রতি লা’নত এবং অভিশাপ দিবেন।

তিনটি উপায়ে উপার্জন ঘৃণিত

হযরত রাফে’ ইবনে খাদীজ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কুকুর বিক্রির মূল্য ঘৃণিত বস্তু, ব্যভিচারের বিনিময়ও অতি জঘন্য, রক্ত ব্যবসাও জঘন্য।

মদের বিষয়ে দশজনের প্রতি লা’নত

হযরত আনাস রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদ সংশ্লিষ্ট দশজনের প্রতি লা’নত করেছেন। ১. যে মদ তৈরি করে, ২. যে মদ তৈরির ফরমায়েশ দেয়, ৩. যে মদ পান করে, ৪. যে মদ বহন করে, ৫. যার প্রতি মদ বহন করা হয়, ৬. যে মদ পান করায়, ৭. যে মদ বিক্রি করে, ৮. যে সেটার মূল্য ভোগ করে, ৯. যে মদ কেনে, ১০. যার জন্য মদ কেনা হয়।

ব্যবসার মধ্যে ক্রেতার প্রতি সহানুভূতি থাকলে মুক্তি লাভ হয়

হযরত হুযাইফা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের এক ব্যক্তির কাছে মালাকুল মউত রূহ কবজ করার জন্য উপস্থিত হলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তুমি কি কোনো বিশেষ নেক আমল করেছ? সে বললো, আমার মনে নেই। বলা হলো, চিন্তা কর। সে বললো, এমন কোন কাজই মনে আসে না একটি কাজ ব্যতীত যে, দুনিয়ার জীবনে আমি আমার লোকদেরকে ক্রেতার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে নির্দেশ দিতাম। আমার ক্রেতা ধনী হলেও তাকে সময় দিতাম। আর যদি সে গরীব হত, তাকে আমার প্রাপ্য মাফ করে দিতাম। এই আমলের বদৌলতে আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তিকে বেহেশত দান করেছেন।

কসম করে মাল বিক্রি করলে বরকত কমে যায়

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, অধিক কসম খাওয়ায় মালের কাটতি বাড়ে। তবে বরকত দূর হয়ে যায়।

আমানতদার ও সৎ ব্যবসায়ীগণ নবী ও সিদ্দীকগণের দলভুক্ত

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সত্যবাদী, আমানতদার, বিশ্বাসী ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দীক ও শহীদগণের সাথে থাকবেন।

Sunday, March 12, 2023

ইউসুফ আ. এর সাথে যুলাইখার বিবাহ

 ইউসুফ আ. এর সাথে যুলাইখার বিবাহ


কোনো কোনো তাফসীরবিদ লিখেছেন, এ সময়ই যুলাইখার স্বামী আযীযে মিসর কিতফীর মৃত্যু বরণ করেন এবং বাদশাহর উদ্যোগে ইউসুফ আ. এর সাথে যুলাইখার বিবাহ সম্পাদন করা হয়। 


তখন ইউসুফ আ. যুলাইখাকে বললেন, তুমি যা চেয়েছিলে, এটা কি তার চাইতে উত্তম নয়? যুলাইখা স্বীয় দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং মহান আল্লাহর দরবারে তাওবা করলেন। 


আল্লাহ তা‘আলা সসম্মানে তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করলেন এবং খুব সুখ-শান্তিতে তাঁদের দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত হয়। ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁদের ঔরশে দুজন পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। তাদের নাম ছিল ইফরায়ীম ও মানশা। 


কোনো কোনো রিওয়ায়েতে আছে, বিবাহের পর আল্লাহর তা‘আলা ইউসুফ আ. এর অন্তরে যুলাইখার প্রতি এত গভীর ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন যে, যুলাইখার অন্তরে ততটুকু ইউসুফ আ.-এর প্রতি ছিল না। এমনকি একবার ইউসুফ আ. যুলাইখাকে অভিযোগের সুরে বললেন, এর কারণ কি যে, আগের ন্যায় আমাকে ভালোবাসো না? উত্তরে যুলাইখা বললেন, আপনার উসিলায় আমি আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা অর্জন করেছি। এ ভালোবাসার সামনে অন্য সব সম্পর্ক ও ভাবনা ম্লান হয়ে গেছে। (তাফসীরে মাযহারী)  


তবে উল্লেখ্য যে, তাঁদের এ বিবাহের এসব ঘটনার স্বপক্ষে মজবুত কোনো হাদীস নেই। সুতরাং এর উপর ততটা ইয়াকীন করা যায় না

Saturday, March 11, 2023

ফেরাউন ও তার কওমের উপর আপতিত আযাব

 ফেরাউন ও তার কওমের উপর আপতিত আযাব


আল্লাহ তা‘আলা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে নয়টি মুজিযা দান করেছিলেন। এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ফেরাউনের সম্প্রদায়কে সতর্ক করে সত্য পথে আনা। এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 


وَلَقَدْ اٰتَيْنَا مُوْسٰى تِسْعَ اٰيَاتٍ...


অর্থঃ আমি মুসা ‘আলাইহিস সালামকে নয়টি প্রকাশ্য মুজিযা প্রদান করেছিলাম। (সূরা বনী-ইসরাঈল, আয়াত: ১০১)


اية

 শব্দটি মুজিযার অর্থেও ব্যবহৃত হয়, আসমানি কিতাবের আয়াত বা আহকামে ইলাহীর অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এখানে উভয় অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। বহু তাফসীরবিদ এই স্থলে اية -এর অর্থ মুজিযা নিয়েছেন।


‘নয়’ সংখ্যা উল্লেখ করা হলেও মুসা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুজিযার সংখ্যা আরো বেশি ছিল, কিন্তু এখানে নয়টি মুজিযার বিশেষ গুরুত্বের কারণে নয় সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে।


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. উক্ত নয়টি মুজিযা এভাবে গণনা করেছেন, ১. মুসা ‘আলাইহিস সালামের লাঠি, যা যমিনে ফেললেই অজগর সাপ হয়ে যেত। ২. মুসা ‘আলাইহিস সালামের শুভ্র হাত, যা বগলের নিচ থেকে বের করতেই উজ্জ্বল হয়ে চমকাতে থাকতো। ৩. মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুখে তোতলামি ছিল, যা অলৌকিকভাবে দূর করে দেওয়া হয়েছিল। ৪. বনী ইসরাইলকে নদী পার করানোর জন্য নদী বিভক্ত করে বারোটি রাস্তা করে দেওয়া হয়েছিল। ৫. ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়ের উপর পঙ্গপালের আযাব এসেছিল। ৬. তাদের প্রতি তুফানের আযাব প্রেরণ করা হয়েছিল। ৭. তাদের শরীরে উঁকুনের আযাব প্রেরণ করা হয়েছিল। ৮. ব্যাঙের আযাব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ৯. তাদের উপর রক্তের আযাব প্রেরণ করা হয়েছিল।


এই নয়টি মুজিযার মধ্যে প্রথম দুটি অর্থাৎ লাঠি সাপ হওয়া এবং হাত জ্যোতির্ময় হওয়া ফেরাউনের দরবারে প্রকাশিত হয়। লাঠি সাপ হয়ে যাওয়ার মুজিযার মাধ্যমেই হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম যাদুকরদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। আর ৫নং থেকে ৯নং পর্যন্ত বর্ণিত পাঁচটি মুজিযা ফেরাউন ও তার কওমের উপর আযাব-গজব নাযিল সংক্রান্ত।


ফেরাউনের কওমের উপর দুর্ভিক্ষের আযাব


অবশ্য এই পাঁচটি আযাব ছাড়াও ফেরাউন ও তার কওমের উপর আরো আযাব অবতীর্ণ হয়েছে বলে বর্ণিত আছে। যেমন, ফেরাউন ও তার কওমের উপর দুর্ভিক্ষের আযাব নাযিল হওয়ার বিষয়েও পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

 

وَلَقَدْ اَخَذْنَا آلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِيْنَ وَنَقْصٍ مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ


অর্থঃ আমি পাকড়াও করেছিলাম ফেরাউনের অনুসারীদের দুর্ভিক্ষ ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি দিয়ে, যেন তারা হিদায়াত গ্রহণ করে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৩০)


যখন ফেরাউনের সম্প্রদায়ের হঠকারিতা ও দুরাচরণের ফলে দুর্ভিক্ষের আগমন হয়েছিল, তখন তাদের ক্ষেতের ফসল ও বাগ-বাগিচার উৎপাদন চরমভাবে হ্রাস পায়। যার দরুন তারা অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তারা ঈমান আনার অঙ্গীকার করে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তিলাভের দু‘আ করায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মুসা ‘আলাইহিস সালামের দু‘আয় দুর্ভিক্ষ রহিত হয়ে গেলে, পুনরায় তারা অহংকার প্রদর্শন করে এবং ঈমান আনতে অস্বীকার করে। উপরন্তু তারা বলতে শুরু করে, এই দুর্ভিক্ষ মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গী-সাথীদের কুলক্ষণের দরুনই আপতিত হয়েছিল। আর এখন যে দুর্ভিক্ষ রহিত হয়ে গিয়েছে, তা হলো আমাদের সৎকর্মের স্বাভাবিক ফল। এমনটিই তো আমাদের প্রাপ্য।


তেমনিভাবে তারা যেকোনো ভালো কিছু পেলে তা নিজেদের কৃতিত্ব মনে করতে থাকে এবং মন্দ ও দুর্দশার সম্মুখীন হলে সেটা মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারীদের কারণে হয়েছে বলে চালিয়ে দিতে থাকে। পবিত্র কুরআনে এ বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, 


فَاِذَا جَآءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوْا لَنَا هٰذِه وَاِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوْا بِمُوْسٰى وَمَنْ مَّعَهٗ اَلَا اِنَّمَا طَآئِرُهُمْ عِنْدَ اللّٰهِ وَلَكِنَّ اَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ


অর্থঃ যখন ভালো দিন ফিরে আসে, তখন তারা বলতে আরম্ভ করে, “আমাদের জন্যই তো এটা।” আর যদি কোন অকল্যাণ এসে উপস্থিত হয়, তবে তার জন্য মুসা ‘আলাইহিস সালাম এবং তার সঙ্গীদের অলক্ষুণে মনে করে। শুনে রাখো, তাদের অলক্ষুণের কথা আল্লাহ তা‘আলারই জানা আছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৩১)


বহু প্রচেষ্টার পরও ফেরাউনসম্প্রদায় হিদায়াতের পথে না আসায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর একের পর এক নানান আযাব-গজব নাযিল করেন। এ সম্পর্কে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 


فَاَرْسَلْنَا عَلَيْهِمُ الطُّوْفَانَ وَالْجَرَادَ وَالْقُمَّلَ وَالضَّفَادِعَ وَالدَّمَ اٰيَاتٍ مُّفَصَّلَاتٍ


অর্থঃ তখন আমি তাদের উপর পাঠালাম তুফান, পঙ্গপাল, উঁকুন, ব্যাঙ ও রক্ত বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৩৩)


এই আয়াতে ফেরাউনের সম্প্রদায়ের উপর আপতিত পাঁচ রকমের আযাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব আযাব اٰيتٍ مُفَصَّلَاتٍ (বহুবিধ নিদর্শন একের পর এক) বলার তাৎপর্য সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি আযাবই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অবস্থান করে। অতঃপর রহিত হয়ে যায়। এরপর কিছুসময় বিরতি দিয়ে পুনরায় দ্বিতীয় বা তৃতীয় কিংবা তৎপরবর্তী আযাবগুলো পৃথক পৃথকভাবে আসে।


ইবনে মুনযির, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন, এগুলোর প্রতিটি আযাব ফেরাউনগোষ্ঠীর উপর সাতদিন করে স্থায়ী হয়। শনিবার শুরু হয়ে দ্বিতীয় শনিবারে রহিত হয়ে যেত এবং পরবর্তী আযাব আসা পর্যন্ত তিন সপ্তাহর অবকাশ দেওয়া হত।


ইমাম বাগাবী রহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, প্রথমবার যখন ফেরাউনের কওমের উপর দুর্ভিক্ষের আযাব আপতিত হয় এবং হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের দু‘আয় তা রহিত হয়ে যায়। কিন্তু তারা নিজেদের নাফরমানী থেকে বিরত হয় না। তখন হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম প্রার্থনা করেন, হে আমার পালনকর্তা, এরা এতই অহংকারী যে, দুর্ভিক্ষের আযাবে কোনরূপ প্রভাবিত হয়নি। তারা নিজেদের কৃত ঈমান আনার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে। সুতরাং তাদের উপর এমন কোন আযাব চাপিয়ে দিন, যা হবে তাদের জন্য বেদনাদায়ক ও আমাদের জাতির জন্য উপদেশ গ্রহণের উপায় এবং যা পরবর্তীদের জন্য হবে সংশোধনমূলক শিক্ষা। তখন আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে তাদের উপর তুফানের আযাব নাযিল করেন।


প্রখ্যাত মুফাসসিরগণের মতে, এখানে তুফান অর্থ পানির তুফান। অর্থাৎ জলোচ্ছ্বাস। তাতে ফেরাউনের সম্প্রদায়ের সমস্ত ঘর-বাড়ি ও জমি-জমা জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়। না থাকে কোথাও তাদের শোয়া-বসার জায়গা, না থাকে জমি চাষাবাদের কোন ব্যবস্থা।


আশ্চর্যের বিষয় ছিল, ফেরাউন গোত্রের সন্দেহ ছিল বনী ইসরাইলের ঘর-বাড়ি ও জমি-জমা জলোচ্ছাসে ডুবে গেছে অথচ বনী ইসরাইলের ঘর-বাড়ি ও জমি-জমা সবই ছিল শুকনো, স্বাভাবিক। সেগুলোর কোথাও জলোচ্ছ্বাসের কোন পানি ছিল না। কিন্তু ফেরাউন সম্প্রদায়ের জমি ছিল অথৈ পানির নিচে।


এই জলোচ্ছ্বাসে ভীত হয়ে ফেরাউনসম্প্রদায় মুসা ‘আলাইহিস সালামের নিকট আবেদন জানালো, আপনার পালনকর্তার দরবারে দু‘আ করুন, যাতে এই আযাব দূর হয়ে যায়। তা হলে আমরা ঈমান আনবো এবং বনী ইসরাইলকে মুক্ত করে দিবো। তখন হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম দু‘আ করলেন। তার দু‘আর ফলে জলোচ্ছ্বাসের তুফান রহিত হয়ে গিয়ে তাদের শস্য-ফসলক্ষেত্র আগের চেয়েও অধিক সুজলা-সুফলা হয়ে উঠলো।


তখন সেই নাফরমানরা বলতে শুরু করলো, আদতে এই তুফান কোন আযাব ছিল না। বরং আমাদের ফায়দার জন্যই তা এসেছিল। যার ফলে আমাদের শস্যভূমির উৎপাদন-ক্ষমতা বেড়ে গেছে। মুসা ‘আলাইহিস সালামের এতে কোন ভূমিকা নেই। সুতরাং আমরা ঈমান আনবো না। এসব কথা বলে তারা ঈমান আনার ব্যাপারে কৃত প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলো।


এমতাবস্থায় তারা মাসাধিকাল সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে। মেহেরবান আল্লাহ তাদের চিন্তা-ভাবনার জন্য অবকাশ দান করেন। কিন্তু তাদের চৈতন্যের উদয় হলো না। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর পঙ্গপালের আযাব নাযিল করলেন। এই পঙ্গপাল তাদের সমস্ত শস্য-ফসল ও বাগানের ফল-ফলাদি খেয়ে নিঃশেষ করে ফেললো। কোন কোন রেওয়ায়াতে এসেছে, কাঠের দরজা-জানালা, ছাদ প্রভৃতিসহ ঘরের ব্যবহার্য্য আসবাবপত্র পঙ্গপাল খেয়ে শেষ করে ফেলেছিল।




আযাব যেভাবে ফেরাউনের কওমকে ধ্বংস করলো


ক্রমাগত এতবার পরীক্ষা ও অবকাশ দানের পরেও যখন ফেরাউনের সম্প্রদায়ের মধ্যে বোধোদয়ের সৃষ্টি হয়নি, তখন তাদের উপর আবর্তিত হয় চূড়ান্ত ও সর্বশেষ আযাব এবং তাতে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। তা এভাবে আসে যে, আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে মুসা ‘আলাইহিস সালামও তার সম্প্রদায় ফেরাউন ও তার জাতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সেদেশ ছেড়ে রওয়ানা হন। তখন ফেরাউন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নিজেদের ঘর-বাড়ি, জমি-জমা ও আসবাবপত্র সবকিছু রেখে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও বনী ইসরাইলের অনুসরণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।


এ সম্বন্ধে তাফসিরে রুহুল মাআনীতে বর্ণিত আছে, হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে রাতের সূচনাভাগে বনী ইসরাইলকে নিয়ে মিসর থেকে লোহিত সাগরের দিকে অর্থাৎ মিসরের পূর্বস্থ এলাকা শামদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।


বনী ইসরাইলের সংখ্যা তখন ছয় লাখ তিন হাজার এবং অন্য রেওয়ায়েত অনুযায়ী ছয় লাখ সত্তর হাজার ছিল। এগুলো ইসরাইলী রেওয়ায়েত বিধায় অতিরঞ্জিত হতে পারে। তবে কুরআনে কারিম ও হাদীস থেকে এতটুকু তথ্য প্রমাণিত যে, তাদের বারটি গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের জনসংখ্যা ছিল বিপুল।


বস্তুত হযরত ইউসুফ ‘আলাইহিস সালামের আমলে বনী ইসরাইল যখন মিসরে আগমন করে, তখন তারা বারো ভাই ছিল। সেই বারো ভাইয়ের বারো গোত্রের এতো বিপুলসংখ্যক লোক মিসর থেকে বের হলো, তাদের সংখ্যা ছয় লাখেরও অধিক বর্ণনা করা হয়।


ফেরাউন তাদের মিসর ত্যাগের সংবাদ সম্বন্ধে অবগত হয়ে নিজ সৈন্যবাহিনীকে একত্র করলো এবং মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার সম্প্রদায়কে পাকড়াও করার জন্য ধাওয়া করলো। ফেরাউনের সাথে সত্তর হাজার কৃষ্ণবর্ণের ঘোড়া ছিল এবং অগ্রবর্তী বাহিনীতে সাত লাখ সওয়ার ছিল।


পিছন দিকে ফেরাউন ও তার সেনাবহর এবং সামনে লোহিতসাগর দেখে বনী ইসরাইল ঘাবড়ে গেল। তাই তারা মুসা ‘আলাইহিস সালামকে বললো,


 اِنَّا لَمُدْرَكُونَ “


“আমরা ধরা পড়ে গেলাম”। (সূরা শুআরা, আয়াত: ৬১)


তখন মুসা ‘আলাইহিস সালাম তাদের সান্তনা দিয়ে বললেন,


 اِنَّ مَعِىَ رَبِّىْ سَيَهْدِيْنِ ○ “


“আমার সাথে আমার পালনকর্তা আছেন। তিনি আমাকে পথ দেখাবেন”। (সূরা শুআরা, আয়াত: ৬২)


এরপর মুসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে সমুদ্রে লাঠি দিয়ে আঘাত করলেন। ফলে সঙ্গে সঙ্গে তাতে বারোটি রাস্তা নির্মিত হয়ে গেল এবং সাগরের পানি প্রাচীরের মতো দণ্ডায়মান হয়ে থাকলো। তখন বনী ইসরাইলের বারোটি গোত্র এসব সড়ক দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে গেল। কুরআনুল কারীমে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, 


فَاَوْحَیْنَاۤ اِلٰی مُوْسٰۤی اَنِ اضْرِبْ بِّعَصَاکَ الْبَحْرَؕ فَانْفَلَقَ فَکَانَ كُلُّ فِرْقٍ کَالطَّوْدِ الْعَظِیْمِ ○ وَ اَزْلَفْنَا ثَمَّ الْاٰخَرِیْنَ ○ وَ اَنْجَیْنَا مُوْسٰی وَ مَنْ مَّعَهٗۤ اَجْمَعِیْنَ○


অর্থঃ অতঃপর আমি মুসা ‘আলাইহিস সালামকে আদেশ করলাম, আপনি নিজের লাঠি দিয়ে সমুদ্রে আঘাত করুন। ফলে সঙ্গে সঙ্গে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতসদৃশ্য হয়ে গেল। আর সেখানে অপর দলকে (ফেরাউনের বাহিনী) পৌঁছে দিলাম। আর আমি হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম। (সূরা শুআরা, আয়াত: ৬৩-৬৫)


ফেরাউন ও তার সৈন্যবাহিনী সমুদ্রের কাছে পৌঁছে এই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। সমুদ্রের বুকে এই রাস্তা কীভাবে তৈরি হলো? কিন্তু এর পরেও ফেরাউন তার সৈনিকদের সগর্বে বললো, এগুলো আমার প্রতাপের লীলা। এর কারণে সমুদ্রের স্রোত বন্ধ হয়ে রাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এ কথা বলে সে সামনে অগ্রসর হয়ে নিজের ঘোড়া সমুদ্রের পথে চালিয়ে দিলো এবং গোটা সৈন্যবাহিনীকে তার পেছনে পেছনে আসার জন্য আদেশ দিলো।


যখন ফেরাউন তার সৈন্যবাহিনীসহ সমুদ্রপথের মাঝখানে এসে গেল এবং একটি লোকও তীরে বাকি রইলো না। অপরদিকে বনী ইসরাইল সমুদ্রের অপর তীরে পৌঁছে গেল। তখন আল্লাহ তা‘আলা সমুদ্রকে রাস্তা বিলীন করে আগের মতো প্রবাহিত হওয়ার হুকুম দিলেন। সমুদ্রের সকল অংশ পরস্পর মিলে গেল। ফলে ফেরাউন ও তার দলবল লোহিতসাগরের মধ্যে পড়ে অথৈ পানি ও স্রোতের গ্রাসে পরিণত হলো। এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 


فَاَغْرَقْنَاهُمْ فِى الْيَمِّ بِاَنَّهُمْ كَذَّبُوْا بِاٰيَاتِنَا وَكَانُوْا عَنْهَا غَافِلِيْنَ○ وَاَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِيْنَ كَانُوْا يُسْتَضْعَفُوْنَ مَشَارِقَ الْاَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِىْ بَارَكْنَا فِيْهَا


অর্থঃ তখন আমি তাদের সাগরের মধ্যে ডুবিয়ে দিলাম। কারণ, তারা মিথ্যাপ্রতিপন্ন করেছিল আমার নিদর্শনসমূহ এবং এ সম্পর্কে তারা উদাসীন ছিল। আর আমি উত্তরাধিকারী করে দিলাম সেই কওমকে, যাদের দুর্বল মনে করা হতো সেই যমিনের পূর্ব ও পশ্চিমের অংশসমূহের, যাতে আমি বরকত স্থাপন করেছিলাম। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১৩৬-১৩৭)


অতঃপর ফেরাউন যখন সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে আরম্ভ করলো, তখন সে বলে উঠলো, আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর উপর, যার উপর বনী ইসরাইল ঈমান এনেছে। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, 


حَتّٰۤی اِذَاۤ اَدْرَکَهُ الْغَرَقُ ۙ قَالَ اٰمَنْتُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا الَّذِیْۤ اٰمَنَتْ بِهٖ بَنُوْۤا اِسْرَآءِیْلَ وَ اَنَا مِنَ الْمُسْلِمِیْنَ○


অর্থঃ এমনকি যখন সে (ফেরাউন) নিমজ্জিত থেকে লাগলো, তখন বললো, আমি ঈমান আনলাম, কোন ইলাহ নেই তিনি ছাড়া, যার প্রতি ঈমান এনেছে বনী ইসরাইল। আমি তারই অনুগতদের দলে। (সূরা ইউনুস, আয়াত: ৯০)


তখন আল্লাহ তা‘আলা ফেরাউনের ঈমান আনার ঘোষণার উত্তরে বলেন, 


آٰلْـٰٔنَ وَقَدْ عَصَیْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِیْنَ


অর্থঃ এতক্ষণে ঈমান এনেছ? অথচ এ যাবত নাফরমানী করে চলেছো এবং ফাসাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত থেকেছ! (কিন্তু এখন যে ঈমান আনার এবং ইসলাম গ্রহণের সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে।) (সূরা ইউনুস, আয়াত: ৯১)


এতে প্রমাণিত হয়, ঠিক মৃত্যুকালে যখন প্রাণ হলোকুমে চলে আসে, সেসময় ঈমান আনা শরী‘আত অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টির আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ সেই হাদীসের দিয়েও প্রতীয়মান হয়, যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবা ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করেন, যতক্ষণ না তার মৃত্যুর ঊর্ধ্বশ্বাস আরম্ভ হয়ে যায়। (তিরমিযী্

মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুজিযা

 মুসা ‘আলাইহিস সালানমের মুজিযা


ফেরাউন উল্লিখিত পন্থায় তার উদ্দেশ্য সাধন করতে ব্যর্থ হয়ে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে প্রমাণ পেশ করার দাবি জানিয়ে বললো,


قَالَ اِنْ كُنْتَ جِئْتَ بِاٰيَةٍ فَاْتِ بِهَا اِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِيْنَ○


অর্থঃ বাস্তবিকই যদি তুমি কোন প্রমাণ নিয়ে এসে থাকো তবে তা উপস্থাপন করো, যদি তুমি সত্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকো। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৬)


তখন হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম তার দাবি মেনে নিয়ে স্বীয় লাঠিখানা মাটিতে ফেলে দিলেন। আর অমনি তা এক বিরাট অজগর সাপে পরিণত হয়ে গেল। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, 


فَاَلْقٰى عَصَاهُ فَاِذَا هِىَ ثُعْبَانٌ مُّبِيْنٌ○


অর্থঃ তখন তিনি তার লাঠিখানা নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জলজ্যান্ত এক অজগর হয়ে গেল। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৭) 


অতঃপর হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম ফেরাউনকে দ্বিতীয় মুজিযা দেখানোর উদ্দেশ্যে নিজের হাতকে বগল থেকে বের করলেন। অমনি তা শুভ্র উজ্জ্বল রূপ ধারণ করলো। নিচের আয়াতে তার এই মুজিযার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে, 


وَنَزَعَ يَدَهٗ فَاِذَا هِىَ بَيْضَاءُ لِلنَّاظِرِيْنَ○


অর্থঃ আর তিনি তার হাত বের করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তা দর্শকদের চোখে ধবধবে উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হলো। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৮)


মুসা ‘আলাইহিস সালামের নবুওয়্যাতের পক্ষে ফেরাউনের প্রমাণ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মুসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে দুটি মুজিযা দেখান। প্রথম মুজিযার বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে, 


فَاَلْقٰى عَصَاهُ فَاِذَا هِىَ ثُعْبَانٌ مُّبِيْنٌ○


অর্থঃ তখন তিনি নিজের লাঠিখানা নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তা জ্যান্ত এক অজগর হয়ে গেল। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৭)

ثُعْبَانٌ

বলা হয় বিরাটকায় অজগরকে। সেই সঙ্গে গুণবাচক শব্দ مُّبِيْنٌ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেই লাঠির সাপ হয়ে যাওয়াটা এমন কোন গোপন ঘটনা ছিল না, যা অন্ধকারে কিংবা পর্দার আড়ালে ঘটেছিল বা যা কেউ কেউ দেখেছিল আর কেউ কেউ দেখেনি। যেমনটা সাধারণত যাদু বা ভেল্কিবাজির বেলায় হয়ে থাকে। বরং সেই ঘটনা এমন প্রকাশ্য স্থানে সাধারণ মানুষের সামনে ঘটেছিল, যা সকলের চোখের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এটাই প্রমাণ যে, সেটা কোন চোখের ধাঁধা নয়, বরং বাস্তবভাবে সংঘটিত ঘটনা ছিল।


কোন কোন ঐতিহাসিকের উদ্ধৃতিতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, সেই অজগর ফেরাউনের প্রতি যখন হা করে মুখ বাড়ালো, তখন সে সিংহাসন থেকে লাফিয়ে পড়ে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের শরণাপন্ন হলো। আর দরবারের বহুলোক ভয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হলো। (তাফসীরে কাবীর)


লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া প্রকৃতিবিরুদ্ধ হওয়ায়, এটা যে বেশ বিস্ময়কর ব্যাপার, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর মুজিযা বা কারামতের উদ্দেশ্যও থাকে তা-ই। যে কাজ সাধারণ মানুষ করতে পারে না, তা নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে করে দেওয়া হয়, যাতে মানুষ বুঝতে পারে, তাদের সঙ্গে খোদায়ী শক্তি বিদ্যমান আছে।


তবে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া বিস্ময়কর হলেও অস্বীকার করার মতো কোন বিষয় ছিল না। কেননা, এটা প্রত্যক্ষকারীদের দিয়ে চাক্ষুষভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় দ্বিতীয় যে মুজিযা পেশ করেন, তা হচ্ছে,


وَنَزَعَ يَدَهٗ فَاِذَا هِىَ بَيْضَاءُ لِلنَّاظِرِيْنَ○


অর্থঃ আর তিনি নিজের হাত বের করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তা দর্শকদের চোখে ধবধবে উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হলো। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৮)

نَزَعَ 

এর মূলধাতু نَزْعٌ -এর অর্থ হলো একটি বস্তুকে অপর একটি বস্তুর ভেতর থেকে কিছুটা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বের করা। সুতরাং এখানে উদ্দেশ্য হলো মুসা ‘আলাইহিস সালাম নিজের হাতখানা টেনে বের করলেন।


মুসা ‘আলাইহিস সালাম হাতখানা কিসের ভেতর থেকে বের করলেন, তা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু কুরআনে কারীমের অন্যত্র বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, 


وَاضْمُمْ يَدَكَ اِلٰى جَنَاحِكَ تَخْرُجْ بَيْضَاءَ مِنْ غَيْرِ سُوْءٍ اٰيَةً اُخْرٰى○


অর্থঃ আর আপনি আপনার হাত বগলে রাখুন। (এরপর তা বের করলে) তা বের হয়ে আসবে নির্মল উজ্জ্বল অবস্থায়। এটা অন্য এক নিদর্শনরূপে প্রদান করা হলো। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ২২)


বস্তুত মুসা ‘আলাইহিস সালাম উক্ত হাত তার বগলের নিচে দাবিয়ে সেখান থেকে বের করে আনলে এই মুজিযা প্রকাশ পেত অর্থাৎ তখন তা দর্শকদের সামনে সূর্যের মতো ঝলমল করতে থাকতো। (তাফসীরে মাযহারী)


বলাবাহুল্য, ফেরাউনের দাবিতে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম দু’টি মুজিযা প্রদর্শন করেছিলেন। একটি হলো লাঠির সাপ হয়ে যাওয়া। অপরটি হলো নিজের হাত মোবারক বগলের নিচে দাবিয়ে বের করে আনলে তা প্রদীপ্ত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠা। প্রথম মুজিযাটি ছিল বিরোধীদের ভীতিপ্রদর্শন করার জন্য আর দ্বিতীয়টি তাদের আকৃষ্ট করে কাছে আনার উদ্দেশ্যে। এতে এই ইংগিত ছিল যে, হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের শিক্ষায় একটি হিদায়াতের জ্যোতি রয়েছে। তাই তার অনুসরণ-অনুকরণই কল্যাণ ও কামিয়াবীর একমাত্র চাবিকাঠি।




মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুজিযা ও ফেরাউনের যাদু


হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের এই দুটি মুজিযা দেখার পরে ফেরাউনের সাঙ্গপাঙ্গরা যে মন্তব্য করলো, নিচের আয়াতে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


قَالَ الْمَلَاُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ اِنَّ هٰذَا لَسَاحِرٌ عَلِيْمٌ○


অর্থঃ ফেরাউনের কওমের সরদাররা বলতে লাগলো, নিশ্চয় এ একজন বিজ্ঞ যাদুকর। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১০৯)


তারা মুজিযার বিস্ময়কর ঘটনা দেখার পর একে যাদু বলে আখ্যায়িত করলো। কিন্তু তারাও এখানে ساحر শব্দের সাথে عليم শব্দটি যোগ করে একথা স্বীকার করলো, হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের মুজিযা সম্পর্কে তাদের মনে এই অনুভূতি জন্মেছে যে, এ কাজটি সাধারণ যাদুকরদের কাজ থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন প্রকৃতির। সেজন্যই তারা বললো, তিনি বড়ই বিজ্ঞ যাদুকর। সাধারণ যাদুকররা এ ধরনের কাজ দেখাতে পারে না।


হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম থেকে উল্লিখিত মুজিযা প্রকাশ পাওয়ার পরে ফেরাউনের কওমের সরদাররা আরো বলতে লাগলো, মুসা যেহেতু একজন বিজ্ঞ যাদুকর, তাই সে তোমাদের দেশান্তর করে দেশ দখল করে নিবে। পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে তাদের উক্ত কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


يُرِيْدُ اَنْ يُّخْرِجَكُمْ مِّنْ اَرْضِكُمْ فَمَاذَا تَاْمُرُوْنَ○


অর্থঃ (তারা বললো,) সে তোমাদের দেশ থেকে তোমাদের বের করে দিতে চায়। এ ব্যাপারে তোমাদের কী মত? (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১০)


ফেরাউনের সম্প্রদায় একথা শুনে উত্তর দিলো, 


اَرْجِهْ وَاَخَاهُ وَاَرْسِلْ فِى الْمَدَائِنِ حَاشِرِيْنَ، يَاْتُوْكَ بِكُلِّ سَاحِرٍ عَلِيْمٍ○


অর্থঃ আপনি তাকে ও তার ভাইকে কিঞ্চিৎ অবকাশ দিন এবং শহরে-বন্দরে লোক প্রেরণ করুন যাদুকরদের সমবেত করার জন্য। তারা আপনার নিকট বিজ্ঞ যাদুকরদের সমাবেশ ঘটাবে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১১)


অর্থাৎ, সম্প্রদায়ের লোকেরা পরামর্শ দিলো, তিনি যদি যাদুকর হয়ে থাকেন এবং যাদু দিয়েই আমাদের দেশ দখল করতে চান, তবে তার মোকাবেলা করা আমাদের জন্য কোন কঠিন ব্যাপার নয়। কারণ, আমাদের দেশে বড় বড় অভিজ্ঞ যাদুকর রয়েছেন, যারা তাকে যাদুর মাধ্যমে পরাভূত করে দিবেন। কাজেই আপনি কিছু সৈন্য-সামন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দিন, তারা গোটা শহর থেকে ভালো যাদুকরদের খুঁজে ডেকে নিয়ে আসবে।


তখন যাদু-মন্ত্রের ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং সাধারণ লোকদের উপর যাদুকরদের প্রচুর প্রভাব ছিল। আর হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকেও লাঠি এবং উজ্জ্বল হাতের মুজিযা এজন্যই দেওয়া হয়েছিল, যাতে তৎকালীন যাদুকরদের সাথে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এবং মুজিযার মোকাবেলায় যাদুর পরাজয় সবাই দেখে নিতে পারে।


আর আল্লাহ তা‘আলার নিয়মও তাই যে, প্রত্যেক যুগের নবী-রাসূলকে তিনি সে-যুগের জনগণের সাধারণ প্রবণতা অনুযায়ী মুজিযা দান করেছেন। হযরত ঈসা ‘আলাইহিস সালামের যুগে গ্রিকবিজ্ঞান ও গ্রিকচিকিৎসা বিজ্ঞান যেহেতু উৎকর্ষের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে ছিল, তাই তাকে মুজিযা দেওয়া হয়েছিল জন্মান্ধকে দৃষ্টিসম্পন্ন করে দেওয়া এবং কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করে তোলা। তেমনি মুসা ‘আলাইহিস সালামকে সেই যুগেরই অনুকূল মুজিযা দিয়েছিলেন।


ফেরাউন তার পরিষদবর্গের পরামর্শ অনুযায়ী হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদ্দেশ্যে সারাদেশ থেকে বিজ্ঞ যাদুকরদের সমবেত করলো। তারা যে সমস্ত যাদুকরকে একত্র করেছিল, তাদের সংখ্যার ব্যাপারে বিভিন্ন ঐতিহাসিক-বর্ণনা রয়েছে। তাদের সংখ্যা বর্ণনাভেদে নয়শ থেকে শুরু করে তিন লক্ষ পর্যন্ত বর্ণিত রয়েছে। তাদের সাথে লাঠি ও দড়ির এক বিরাট স্তূপও ছিল, যা তিনশ উটের পিঠে বোঝাই করে আনা হয়েছিল। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন)  


ফেরাউনের যাদুকররা প্রথমে এসেই দরকষাকষি করতে শুরু করলো, আমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে এবং তাতে জয়ী হলে, আমরা কী পাবো? এমনটি করার কারণ হচ্ছে, যারা দুনিয়াপন্থী, পার্থিব লাভই হলো তাদের মুখ্য। কাজেই যেকোনো কাজ করার আগে তাদের সামনে থাকে বিনিময় কিংবা লাভের প্রশ্ন। কুরআনে কারীমের নিম্নোক্ত আয়াতে তাদের এই দরকষাকষির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


وَجَاءَ السَّحَرَةُ فِرْعَوْنَ قَالْوْا اِنَّ لَنَا لَاَجْرًا اِنْ كُنَّا نَحْنُ الْغَالِبِيْنَ○


অর্থঃ যাদুকররা ফেরাউনের কাছে এসে উপস্থিত হলো। তারা বললো, আমাদের জন্য কোন পারিশ্রমিক আছে কি, যদি আমরা জয় লাভ করি? (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৩)


পক্ষান্তরে নবী-রাসূল এবং যারা তাদের নায়েব তথা হক্কানী আলেম, তারা প্রতিপদক্ষেপে ঘোষণা করেন, 


وَمَا اَسْئَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ اَجْرٍ، اِنْ اَجْرِىَ اِلَّا عَلٰى رَبِّ الْعَالَمِيْنَ○


অর্থঃ আমরা যে সত্যের বাণী আপনাদের নিকট পৌঁছে দিই, আপনাদের কাছে তার কোন প্রতিদান আশা করি না। বরং আমাদের প্রতিদানের বিষয় শুধু আল্লাহ তা‘আলার উপরই ন্যস্ত রয়েছে। (সূরা শুআরা, আয়াত: ১৪৫)


যাদুকরদের পারিশ্রমিক দাবির জবাবে ফেরাউন তাদের বললো, তোমরা পারিশ্রমিক চাচ্ছো? আমি তোমাদের পারিশ্রমিক তো দিবই, উপরন্তু তোমাদের শাহী-দরবারের ঘনিষ্ঠদেরও অন্তর্ভুক্ত করে নিবো (যা পারিশ্রমিক থেকে হাজারগুণ মূল্যবান)। কুরআনে কারীমের এক আয়াতে এ কথা তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


قَالَ نَعَمْ وَاِنَّكُمْ لَمِنَ الْمُقَرَّبِيْنَ○


অর্থঃ সে (ফেরাউন) বললো, হ্যাঁ, এবং অবশ্যই তোমরা আমার নিকটবর্তী লোক হয়ে যাবে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৪)


ফেরাউনের সাথে এসব কথাবার্তা বলে নেওয়ার পর যাদুকররা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্থান ও সময় সাব্যস্ত করিয়ে নিলো। এক বিস্তৃত ময়দানে এবং এক উৎসবের দিনে সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় নির্দিষ্ট হলো। এ সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, 


قَالَ مَوْعِدُكُمْ يَوْمُ الزِّينَةِ وَاَن يُحْشَرَ النَّاسُ ضُحًى○


অর্থঃ হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম বললেন, তোমাদের নির্ধারিত সময় তোমাদের উৎসবের দিন এবং লোকজন যেন পূর্বাহ্নেই সমবেত হয়। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৫৯)


কোন কোন রেওয়ায়াতে বর্ণিত আছে, এ সময় যাদুকরদের সরদারের সাথে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম আলোচনা করলেন, আমি যদি তোমাদের উপর বিজয় লাভ করি, তবে তোমরা ঈমান গ্রহণ করবে তো? তারা বললো, আমাদের কাছে এমন মহাযাদু রয়েছে, যার উপর কেউ জয়ী হতে পারে না। কাজেই আমাদের পরাজয়ের প্রশ্ন উঠতে পারে না। তথাপি যদি আপনি জয়ী হয়ে যান, তা হলে প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে ফেরাউনের চোখের সামনে আমরা আপনার প্রতি ঈমান গ্রহণ করবো। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন লিল কুরতুবী)


অতঃপর প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দানে যখন সবাই সমবেত হলো তখন যাদুকররা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে উদ্দেশ্য করে যা বলেছিল, এক আয়াতে সে কথাই বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


قَالُوْا يَا مُوْسٰى اِمَّا اَنْ تُلْقِىَ وَاِمَّا اَنْ نَّكُوْنَ نَحْنُ الْمُلْقِيْنَ○


অর্থঃ তারা বললো, হে মুসা, হয় আপনি নিক্ষেপ করুন না-হয় আমরা নিক্ষেপকারী হই। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৫)


যাদুকরদের এই উক্তিটি ছিল নিজেদের নিশ্চিন্ততা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে যে, এ ব্যাপারে আমাদের কোন পরোয়াই নেই- প্রথমে আমরা শুরু করবো, না আপনি। কারণ, আমরা নিজেদের যাদুশাস্ত্রের ব্যাপারে সম্পূর্ণ আশ্বস্ত।


তাদের বর্ণনাভঙ্গিতে একথা বুঝা যায় যে, তারা মনে মনে প্রথম আক্রমণের প্রত্যাশী ছিল। কিন্তু নিজেদের শক্তিমত্তা ও বাহাদুরি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করে নিলো, প্রথমে আপনি আরম্ভ করবেন, না আমরা।


হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম তাদের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে নিজের মুজিযা সম্পর্কে পরিপূর্ণ নিশ্চয়তার দরুন প্রথমে তাদেরই সুযোগ দিলেন। পবিত্র কুরআনের ভাষায়,   قَالَ اَلْقُوْا   “তিনি বললেন, তোমরাই আগে নিক্ষেপ করো।”


আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাসীর রহ. তার বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরুল কুরআনিল আযীমে” একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, যাদুকররা হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামের প্রতি আদব প্রদর্শন ও সম্মানজনক ব্যবহার করতে গিয়েই প্রথম সুযোগ নেওয়ার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তাই এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ঈমান আনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে আগেই বলা হয়েছে, মুসা ‘আলাইহিস সালাম সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে তাদেরই প্রথমে নিক্ষেপ করার জন্য বললেন।


সুতরাং যাদুকররা-ই প্রথমে তাদের লাঠি ও দড়িগুলো নিক্ষেপ করলো। সঙ্গে সঙ্গে সেসব দিয়ে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, এক আয়াতে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, 


فَلَمَّا اَلْقَوْا سَحَرُوْا اَعْيُنَ النَّاسِ وَاسْتَرْهَبُوهُمْ وَجَاءُوْا بِسِحْرٍ عَظِيْمٍ○


অর্থঃ যখন তারা নিক্ষেপ করলো, তখন তারা লোকদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিলো এবং তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুললো। তারা প্রদর্শন করলো এক মহাযাদু। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৬)


অর্থাৎ যাদুকররা তাদের লাঠি ও রশিগুলো মাটিতে নিক্ষেপ করার সাথে সাথে সেগুলো বড় বড় সাপ হয়ে ছোটাছুটি শুরু করলো। এভাবে তারা দর্শকদের নজরবন্দি করে দিয়ে এক মস্তবড় যাদু দেখালো। তাদের যাদু দিয়ে উপস্থিত লোকজন খুবই প্রভাবান্বিত হলো এবং বড় বড় বহুসংখ্যক সাপ দেখে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেল।


এই আয়াতের দিয়ে বুঝা যায়, তাদের যাদু ছিল একপ্রকার নজরবন্দি। যাতে দর্শকদের মনে থেকে লাগলো, এই লাঠি ও দড়িগুলো সাপ হয়ে ছোটাছুটি করছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আগের মতোই লাঠি ও দড়ি ছিল। বাস্তবে সেগুলো কোন সাপ হয়নি। বস্তুত এটা এক প্রকার সম্মোহনীশক্তি ছিলো, যার প্রভাব মানুষের কল্পনা ও দৃষ্টিকে ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো।


এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা‘আলা তার নবী হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে যে নির্দেশ দিলেন, কুরআন মজীদের এক আয়াতে এভাবে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, 


وَاَوْحَيْنَا اِلٰى مُوسٰى اَنْ اَلْقِ عَصَاكَ فَاِذَا هِىَ تَلْقَفُ مَا يَاْفِكُوْنَ○


অর্থঃ তারপর আমি ওহীর মাধ্যমে মুসা ‘আলাইহিস সালামকে বললাম, আপনার লাঠিখানা নিক্ষেপ করুন। তা নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে সে (মুসা ‘আলাইহিস সালাম এর সাপ), সবগুলোকে (যাদুকরদের সাপগুলোকে) গিলতে লাগলো, যা তারা বানিয়েছিল যাদুর বলে। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত: ১১৭)


অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে মুসা ‘আলাইহিস সালাম তার লাঠিখানা মাটিতে ফেলে দিতেই লাঠিটি সবচেয়ে বড় সাপে পরিণত হয়ে যাদুকরদের সকল সাপ গিলে খেতে শুরু করলো।

ঐতিহাসিক-বর্ণনায় রয়েছে, হাজার হাজার যাদুকরের হাজার হাজার লাঠি ও রশি যখন সাপ হয়ে দৌড়াতে লাগলো, তখন সমগ্র মাঠ সাপে ভরে গেল এবং সমবেত দর্শকদের মাঝে তাতে এক অদ্ভুত ভীতির সঞ্চার হলো। এমনকি হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামও কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কুরআনে কারীমে এই দিকেই ইংগিত করে বলা হয়েছে, 


فَاِذَا حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ يُخَيَّلُ اِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ اَنَّهَا تَسْعٰى○ فَاَوْجَسَ فِىْ نَفْسِه خِيْفَةً مُّوْسٰى○ قُلْنَا لَا تَخَفْ اِنَّكَ اَنْتَ الْاَعْلٰى○


অর্থঃ তাদের যাদুক্রিয়ার প্রভাবে তার মনে হলো, যেন হঠাৎ তাদের রশি ও লাঠিগুলো সাপ হয়ে ছোটাছুটি করছে। তখন মুসা ‘আলাইহিস সালাম মনে মনে কিছুটা ভীতি অনুভব করলেন। আমি বললাম, ভয় করবেন না, নিশ্চয় আপনিই বিজয়ী হবেন। (সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৬৬-৬৮)


কিন্তু হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালাম তার এই ভয় মনের ভেতর গোপন রাখলেন। প্রকাশ হতে দেননি। এই ভয় যদি প্রাণনাশের ভয় হয়ে থাকে, তবে মানুষ হিসাবে এরূপ হওয়া নবুওয়্যাতের পরিপন্থী নয়। কিন্তু বাহ্যত বুঝা যায়, এটা প্রাণনাশের ভয় ছিল না; বরং তিনি আশঙ্কা করছিলেন, এরা লাঠি ও দড়ি ফেলেছে, তাতে সেগুলো সাপ হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় যখন আমি লাঠি ফেলবো, তাও সাপ হয়ে যাবে। তাতে তো সব এক রকমই হয়ে গেল। সুতরাং মানুষ নবুওয়্যাতের মুজিযার পার্থক্য করবে কিভাবে!


অপরদিকে তিনি ভাবলেন, আমার সাপ মাত্র একটা হবে, অথচ তাদের সাপের সংখ্যা অনেক বেশি। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ মহাসমাবেশের সামনে যদি যাদুকররা জিতে যায়, তবে নবুওয়্যাতের দাওয়াতের উদ্দেশ্য তো পূর্ণ হতে পারবে না। এর জবাবে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, 


لَا تَخَفْ اِنَّكَ اَنْتَ الْاَعْلٰى


অর্থঃ আপনি ভয় পাবেন না, আপনিই বিজয়ী হবেন।


এতে আল্লাহর নবী হযরত মুসা ‘আলাইহিস সালামকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যাদুকররা জয়ী হতে পারবে না। আপনিই তাদের উপর বিজয় ও প্রাধান্য লাভ করবেন। এভাবে তার উপরোক্ত আশঙ্কা দূর করে দেওয়া হয়।


Friday, March 10, 2023

ইউসুফ আ. কে হত্যার পরিকল্পনা

 ইউসুফ আ. কে হত্যার পরিকল্পনা


পরামর্শের এক পর্যায়ে তাদের একজন এ মত পেশ করলো যে, ইউসুফকে হত্যা করা হোক। অন্য একজন বললো, তাকে হত্যা না করে কোনো দূরদেশে ফেলে আসা হোক। এতে করে মাঝখান থেকে এ কাঁটা দূর হয়ে যাবে এবং পিতার সব মনোযোগ আমাদের প্রতিই নিবদ্ধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তাকে হত্যা কিংবা দেশান্তরের কারণে যে গুনাহ হবে, তার প্রতিকার এই যে, পরবর্তীকালে তাওবা করে আমরা ভালো হয়ে যাবো। শিরোনামে উল্লিখিত “এবং তারপর ভালো হয়ে যাবো” বাক্যের এক অর্থ তা-ই বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফকে হত্যা করার পর আমাদের অবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। কেননা, তখন পিতার মনোযোগের কেন্দ্র শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং মনোযোগ আমাদের দিকেই নিবদ্ধ হবে এবং আমরা ভালো পরিগণিত হবো।


সেই মুহূর্তে তাদের মধ্যেরই একজন সমস্ত কথাবার্তা শুনে বললো, ইউসুফকে হত্যা করা উচিৎ হবে না। বরং যদি কিছু করতেই হয়, তবে তাকে কূপের গভীরে এমন জায়গায় নিক্ষেপ করা হোক, যেখানে সে জীবিত থাকবে এবং পথিক যখন কূপে আসবে, তখন তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। এভাবে একদিকে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে এবং চিন্তা করতে হবে না। বরং এমতাবস্থায় কোন পথিকই তাকে দূরদেশে নিয়ে চলে যাবে। 


এ অভিমত প্রকাশকারী ছিলো তাদের বড় ভাই ইয়াহুদা। কোন কোন রিওয়ায়েতে আছে যে, সবার মধ্যে রুবীল ছিল বড়। সে-ই এ অভিমত ব্যক্ত করছিল। এ ব্যক্তি সম্পর্কে সামনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিসরে যখন ইউসুফ আ. এর ছোট ভাই বিনয়ামীনকে আটক করা হয়, তখন সে বলেছিলো, আমি ফিরে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাবো? তাই আমি আর কেনানে ফিরে যাবো না।



পরিকল্পনার বাস্তবায়ন


হযরত ইউসুফ আ. এর ভায়েরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পিতার কাছে এভাবে আবেদন পেশ করলো যে, আব্বাজান! ব্যাপার কী! আপনি দেখি ইউসুফ সম্পর্কে আমাদের প্রতি আস্থা রাখেন না! অথচ আমরা তার পুরোপুরি হিতাকাঙ্ক্ষী। আগামীকাল আপনি তাকে আমাদের সাথে ভ্রমণে পাঠিয়ে দিন, যাতে সেও স্বাধীনভাবে পানাহার ও খেলাধুলা করতে পারে। আমরা সবাই তার পুরোপুরি দেখাশোনা করবো।


তাদের এ আবেদন থেকেই বোঝা যায় যে, এর আগেও তারা কোনো সময় এ ধরনের আবেদন করেছিল, যা পিতা অগ্রাহ্য করেছিলেন। যদ্দরূণ এবার কিঞ্চিত জোর ও পীড়াপীড়ি সহকারে পিতাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ আবেদন সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,


قَالُوْا یٰۤاَبَانَا مَا لَکَ لَا تَاْمَنَّا عَلٰی یُوْسُفَ وَ اِنَّا لَهٗ لَنٰصِحُوْنَ○ اَرْسِلْهُ مَعَنَا غَدًا یَّرْتَعْ وَیَلْعَبْ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ○


অর্থঃ তারা বললো, হে আমাদের আব্বা! আপনার কী হয়েছে যে, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশ্বাস করেন না? অথচ আমরা তো তার শুভাকাঙ্ক্ষী। আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে প্রেরণ করুন। তাহলে সে তৃপ্তিসহ খাবে এবং খেলাধুলা করবে, আর আমরা অবশ্যই তার হিফাযত করবো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১১-১২)


ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা যখন আগামীকাল ইউসুফকে তাদের সাথে ভ্রমণে পাঠানোর আবেদন করলো, তখন হযরত ইয়াকূব আ. বললেন, তাকে পাঠানো আমি দু’কারণে পছন্দ করি না। প্রথমতঃ সে নয়নের মণি, আমার সামনে না থাকলে, আমি শান্তি পাই না। দ্বিতীয়তঃ আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, জঙ্গলে তোমাদের অসাবধানতার মুহূর্তে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলতে পারে। 


ইয়াকূব আ. এর এ বক্তব্য কালামে পাকের এ আয়াতে বিবৃত হয়েছে, 


قَالَ اِنِّیْ لَیَحْزُنُنِیْۤ اَنْ تَذْهَبُوْا بِهٖ وَ اَخَافُ اَنْ یَّاْكُلَهُ الذِّئْبُ وَاَنْتُمْ عَنْهُ غٰفِلُوْنَ○


অর্থঃ ইয়াকূব আ. বললেন, আমার দুশ্চিন্তা হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশঙ্কা করি যে, বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে, অথচ তোমরা তার থেকে অমনোযোগী থাকবে। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৩)


বাঘের আশঙ্কা হওয়ার কারণ এই যে, তখন কেনানে বাঘের খুব উপদ্রব ছিল। ওদিকে হযরত ইয়াকূব আ. স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, তিনি পাহাড়ের উপর আছেন। নীচে পাহাড়ের পাদদেশে ইউসুফ আ.। হঠাৎ দশটি বাঘ এসে তাঁকে ঘেরাও করে ফেলে এবং আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু সেগুলোর মধ্য থেকে একটি বাঘ এসে তাঁকে মুক্ত করে দেয়, অতঃপর ইউসুফ আ. মাটির অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেন। 


এর ব্যাখ্যা এভাবে প্রকাশ পায় যে, দশটি বাঘ ছিল দশজন ভাই এবং যে বাঘটি তাঁকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে, সে ছিল বড় ভাই ইয়াহুদা অথবা রুবীল। আর মাটির অভ্যন্তরে গা ঢাকা দেয়ার অর্থ, কূপের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়া। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এ স্বপ্নের ভিত্তিতে হযরত ইয়াকূব আ. স্বয়ং এ ভাইদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করেছিলেন এবং তাদরকেই বাঘ বলেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে ওদের কাছে কথা প্রকাশ করেননি। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন লিল কুরতুবী)


ভাইয়েরা হযরত ইয়াকূব আ. এর এ কথা শুনে বললো, আপনার এ ভয়-ভীতি অমূলক। আমরা দশজনের শক্তিশালী দল তার হেফাজাতের জন্য বিদ্যমান রয়েছি। আমাদের সবার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘেই তাকে খেয়ে ফেলে, তাহলে আমাদের অস্তিত্বই নিষ্ফল হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় আমাদের দিয়ে কোন্ কাজের আশা করা যেতে পারে?


নিম্নোলিখিত আয়াতে ইউসুফ আ. এর ভোইদের সেই কথা বর্ণনা করা হয়েছে, 


قَالُوْا لَئِنْ اَکَلَهُ الذِّئْبُ وَنَحْنُ عُصْبَۃٌ اِنَّاۤ اِذًا لَّخٰسِرُوْنَ○


অর্থঃ তারা বললো, আমরা একটি ভারী দল থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘ তাকে খেয়ে ফেলে, তবে তো আমরা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৪)


হযরত ইয়াকূব আ. পয়গাম্বরসুলভ গাম্ভীর্যের কারণে ছেলেদের সামনে এ কথা প্রকাশ করলেন না যে, আমি স্বয়ং তোমাদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করি। কারণ এতে প্রথমতঃ তাদের মনোকষ্ট হতো, দ্বিতীয়তঃ পিতার এরূপ বলার দিয়ে ভাইদের শত্রুতা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। ফলে এখন ছেড়ে দিলেও অন্য কোনো সময় কোনো ছলছুতায় তাঁকে হত্যা করার ফিকিরে থাকতো। তাই তিনি তাঁকে নিয়ে যাবার অনুমতি দিয়ে দিলেন। তবে ভাইদের কাছ থেকে অঙ্গীকারও নিয়ে নিলেন, যাতে ইউসুফের কোনো রকম কষ্ট না হয়। এ পর্যায়ে বিশেষ করে বড় ভাই ইয়াহুদার হাতে তাকে সোপর্দ করে বললেন, তুমি তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও অন্যান্য প্রয়োজনের ব্যাপারে খেয়াল রাখবে এবং শীঘ্র ফিরিয়ে আনবে।


ভাইরা পিতার সামনে ইউসুফকে কাঁধে তুলে নিলো এবং পালাক্রমে সবাই উঠাতে লাগলো। কিছু দূর পর্যন্ত হযরত ইয়াকূর আ. ও তাদেরকে বিদায় জানানোর জন্যে গেলেন।


ইমাম কুরতুবী রহ. ঐতিহাসিক রিওয়ায়েতের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, তারা যখন হযরত ইয়াকূব আ. এর দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, তখন তারা ইউসুফ আ. কে নামিয়ে দিল এবং তিনি পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। কিন্তু অল্প বয়স্ক হওয়ার কারণে তাদের সাথে সাথে চলতে অক্ষম হচ্ছিলেন আবার তাকে হত্যা করার ব্যাপারে ভাইদের পরামর্শও টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি এক ভাইয়ের আশ্রয় নিতে চাইলেন। সে কোনোরূপ সহানুভূতি প্রদর্শন না করায় তৃতীয়, চতুর্থ; এমনিভাবে প্রত্যেক ভাইয়ের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু সবাই উত্তর দিল যে, তুই যে এগারোটি নক্ষত্র এবং চাঁদ ও সূর্য তোকে সিজদা করতে দেখেছিস, তাদেরকে ডাক দে, তারাই তোকে সাহায্য করবে, আমরা তোকে সাহায্য করতে পারবো না। 


ইমাম কুরতুবী রহ. এর ভিত্তিতে বলেন যে, এ থেকে বোঝা যায় ভাইয়ের কোনো না কোনো উপায়ে ইউসুফ আ. এর স্বপ্নের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হয়েছিল। সে স্বপ্ন ইউসুফ আ. এর প্রতি তাদের তীব্র ক্রোধ ও কঠোর ব্যবহারের কারণ হয়েছিল। উক্ত স্বপ্নের কারণেই তারা ইউসুফ আ. এর সাথে হিংসাত্মক আচরণ করেছিল। 


অবশেষে ইউসুফ আ. ইয়াহুদাকে বললেন, আপনি সবার বড়। আপনিই আমার দুর্বলতা ও অল্পবয়স্কতা এবং পিতার মনোকষ্টের কথা চিন্তা করে দয়ার্দ্র হোন। আপনি ঐ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করুন যা পিতার সাথে করেছিলেন। একথা শুনে ইয়াহুদার মনে দয়ার সঞ্চার হলো এবং তাকে বললো, যতক্ষণ আমি জীবিত আছি, এসব ভাই তোমাকে কোনো কষ্ট দিতে পারবে না। 


তখন ইয়াহুদার অন্তরে আল্লাহ তা‘আলা দয়া ও ন্যায়ানুগ কাজ করার প্রেরণা জাগ্রত করে দিলেন। সে অন্যান্য ভাইকে সম্বোধন করে বললো, নিরপরাধকে হত্যা করা মহাপাপ। আল্লাহকে ভয় করো এবং বালকটিকে তার পিতার কাছে নিয়ে চলো। তবে তার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে নাও যে, সে পিতার কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করবে না। ভাইয়ের উত্তর দিল, আমরা জানি, তোমার উদ্দেশ্য কী? তুমি পিতার অন্তরে নিজের মর্যাদার আসন সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চাও। মনে রাখো, যদি তুমি আমাদের ইচ্ছা পূরণে প্রতিবন্ধক হও, তবে আমরা তোমাকেও হত্যা করবো। 


ইয়াহুদা দেখলো যে, নয় ভাইয়ের বিপরীতে সে একা কিছু করতে পারবে না। তাই সে বললো, তোমরা যদি এ বালককে নিপাত করতে মনস্থ করে থাকো, তবে আমার কথা শোনো, নিকটেই একটি প্রাচীন কূপ রয়েছে। এতে অনেক ঝোপ-জঙ্গল গজিয়েছে। সাপ, বিচ্ছু ও হরেক রকমের ইতর প্রাণী এখানে বাস করে। তোমরা তাকে সেই কূপে ফেলে দাও। যদি কোনো সাপ ইত্যাদি তাকে দংশন করে শেষ করে দেয়, তবে তোমাদের উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে এবং নিজ হাতে হত্যা করার দোষ থেকে তোমরা মুক্ত থাকবে। পক্ষান্তরে যদি সে জীবিত থাকে, তবে হয়তো কোনো কাফেলা এখানে আসবে এবং পানির জন্য কূপে বালতি ফেলবে। ফলে সে বের হয়ে আসবে। আর তারা তাকে সাথে করে অন্য কোনো দেশে পৌঁছে দেবে। এমতাবস্থায়ও তোমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে যাবে।



ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ


এ প্রস্তাবে ভাইয়েরা সবাই একমত হলো। তাদের এ বিষয়টি নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে,  


فَلَمَّا ذَهَبُوْا بِهٖ وَ اَجْمَعُوْۤا اَنْ یَّجْعَلُوْهُ فِیْ غَیٰبَتِ الْجُبِّ ۚ وَ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمْ بِاَمْرِهِمْ هٰذَا وَهُمْ لَا یَشْعُرُوْنَ○


অর্থঃ অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে চললো, এবং অন্ধকার কূপের গভীরে নিক্ষেপ করতে একমত হলো, তখন আমি তাকে ওহী দিয়ে জানিয়ে দিলাম যে, অবশ্যই তুমি তাদেরকে তাদের এ কাজের কথা এক সময় স্মরণ করিয়ে দিবে, আর তারা তখন তোমার উঁচু মর্যাদার কারণে তোমাকে চিনবে না। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৫)


ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, এ ওহী সম্পর্কে দু প্রকার ব্যাখ্যা থেকে পারে। (এক) কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাঁর সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদ দানের জন্য এ ওহী পাঠানো হয়েছিল। (দুই) কূপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগে আল্লাহ তা‘আলা ওহীর মাধ্যমে ইউসুফ আ. কে ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী জানিয়ে দিয়েছিলেন। এতে আরো বলে দিয়েছিলেন যে, তুমি এভাবে ধ্বংস হওয়ার কবল থেকে মুক্ত থাকবে এবং এমন পরিস্থিতি দেখা দিবে যে, তুমি তাদের তিরস্কার করার সুযোগ পাবে। অথচ তারা ধারণা করবে না যে, তুমিই তাদের ভাই ইউসুফ। কারণ, তখন তুমি অনেক উচ্চ মর্যাদায় অবস্থান করবে। এক পর্যায়ে তারা হযরত ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলো। তখন তিনি কূপের প্রাচীর জড়িয়ে ধরলেন। ভাইয়েরা তাঁর জামা খুলে তা দিয়ে তাঁর হাত বাঁধলো। তখন ইউসুফ আ. পুনরায় তাদের কাছে দয়া ভিক্ষা চাইলেন। কিন্তু তখনও তারা আগের মতো সেই উত্তরই দিল যে, যে এগারোটি নক্ষত্র তোকে সিজদা করেছিল, তাদেরকে ডাক দে। তারাই তোকে সাহায্য করবে। অতঃপর ভাইয়েরা তাকে বালতিতে ভরে কূপে ছাড়তে লাগলো। সেটা মাঝপথে যেতেই উপর থেকে রশি কেটে দিল। 


আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং ইউসুফ আ. কে হিফাযত করলেন। যদ্দরূণ পানিতে পড়ার কারণে তিনি কোনোরূপ আঘাত পেলেন না। অতঃপর নিকটেই একখণ্ড ভাসমান প্রস্তর দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি সুস্থ ও বহাল তবিয়তে তার উপরে বসে রইলেন। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে যে, জিবরাঈল আ. আল্লাহ পাকের আদেশ পেয়ে তাঁকে প্রস্তর খণ্ডের উপর বসিয়ে দেন। ইউসুফ আ. তিন দিন কূপে অবস্থান করেন। ইয়াহুদা প্রত্যহ গোপনে তাঁর জন্য কিছু খাদ্য আনতো এবং বালতির সাহায্যে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতো। ইউসুফ আ. কে কূপে নিক্ষেপ করার পর তাঁর ভাইয়েরা সন্ধ্যা বেলায় কান্না করতে করতে তাদের পিতার নিকট উপস্থিত হলো। বিষয়টিকে নিম্নোক্ত আয়াতে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, 


وَجَآءُوْۤا اَبَاهُمْ عِشَآءً یَّبْكُوْنَ○


অর্থঃ আর তারা রাতের অন্ধকারে কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এলো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৬)


হযরত ইয়াকূব আ. কান্নার শব্দ শুনে বাইরে এলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী! তোমাদের ছাগল পালের উপর কেউ আক্রমণ করেনি তো? ইউসুফ কোথায়? তখন ভাইয়েরা যা বললো, তা পবিত্র কুরআনে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে, 


قَالُوْا یٰۤاَبَانَاۤ اِنَّا ذَهَبْنَا نَسْتَبِقُ وَتَرَكْنَا یُوْسُفَ عِنْدَ مَتَاعِنَا فَاَکَلَهُ الذِّئْبُ ۚ وَمَاۤ اَنْتَ بِمُؤْمِنٍ لَّنَا وَلَوْ كُنَّا صٰدِقِیْنَ○


অর্থঃ তারা বললো, হে আমাদের আব্বা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের আসবাবপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। তখন তাকে নেকড়ে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না; যদিও আমরা সত্যবাদী হই। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৭)


ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা তাঁর জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে এনেছিল, যাতে পিতার মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, বাঘই তাঁকে খেয়ে ফেলেছে। পবিত্র কুরআনে তাদের এ প্রতারণার কথা এভাবে বিবৃত হয়েছে, 


وَجَآءُوْ عَلٰی قَمِیْصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ


অর্থঃ তারা ইউসুফের জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে আনলো। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮) 


কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের মিথ্যা ফাঁস করে দেয়ার জন্য তাদেরকে একটি জরুরী বিষয় থেকে গাফেল করে দিয়েছিলেন। তারা যদি রক্ত লাগানোর সাথে সাথে জামাটিও ছিন্ন করে দিত, তবে তারা ইউসুফকে বাঘে খাওয়ার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করতে পারতো। কিন্তু তারা অক্ষত জামায় ছাগল ছানার রক্ত মাখিয়ে পিতাকে ধোঁকা দিতে চাইলো। ইয়াকূব আ. অক্ষত জামা দেখে বললেন, বাছারা! এ বাঘ কেমন বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান ছিল যে, ইউসুফকে তো খেয়ে ফেলেছে; কিন্তু জামার কোনো অংশ ছিন্ন হতে দেয়নি! 


এভাবে হযরত ইয়াকূব আ. এর কাছে তাদের জালিয়াতি ফাঁস হয়ে গেলে তিনি যা বললেন, তা কুরআন মাজীদের ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে 


وَجَآءُوْ عَلٰی قَمِیْصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ قَالَ بَلْ سَوَّلَتْ لَكُمْ اَنْفُسُكُمْ اَمْرًا ؕ فَصَبْرٌ جَمِیْلٌ ؕ وَاللهُ الْمُسْتَعَانُ عَلٰی مَا تَصِفُوْنَ○


অর্থঃ ইয়াকূব আ. বললেন, (এটা কারণই নয়;) বরং তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা কথা সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এখন পূর্ণ ধৈর্য্য ধারণ করাই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছো, সে সম্বন্ধে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৮)


গভীর কূপ থেকে মুক্তি


ওদিকে আল্লাহর মেহেরবানীতে একটি কাফেলা সেই অন্ধকার কূপের কাছে এসে উপস্থিত হয়। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে, এ কাফেলা সিরিয়া থেকে মিসর যাচ্ছিল। পথ ভুলে এ জনমানবহীন জঙ্গলে এসে পড়েছে। তারা পানি সংগ্রহকারীদেরকে পানি খোঁজার জন্য কূপে প্রেরণ করলো। মিসরীয় কাফেলার পথ ভুলে এখানে পৌঁছা এবং এই অন্ধকারকূপের সম্মুখীন হওয়া সাধারণ দৃষ্টিতে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে। কিন্তু যারা সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে ভালো জানেন, তারা জানেন যে, এসব ঘটনা একটি অপরটির সাথে পরস্পর সংযুক্ত ও অটুট ব্যবস্থাপনার মিলিত অংশ। হযরত ইউসুফ আ. এর স্রষ্টা ও রক্ষকই কাফেলাকে তাদের গন্তব্যের পথ থেকে সরিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন এবং ইউসুফকে সাহায্য করার জন্য কাফেলার লোকদেরকে এই অন্ধকার কূপে প্রেরণ করেছেন। 

পানি আনার জন্য কাফেলার মালিক ইবনে দোবর নামক জনৈক ব্যক্তি সেই কূপে পৌঁছেন এবং বালতি নিক্ষেপ করলেন। ইউসুফ আ. সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য প্রত্যক্ষ করে বালতির রশি শক্ত করে ধরলেন। পানির পরিবর্তে বালতির সাথে একটি সমুজ্জ্বল মুখমণ্ডল পানি উত্তোলনকারীর দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো। পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে সে কথা ব্যক্ত করা হয়েছে,


وَجَآءَتْ سَیَّارَۃٌ فَاَرْسَلُوْا وَارِدَهُمْ فَاَدْلٰی دَلْوَهٗ ؕ قَالَ یٰبُشْرٰی هٰذَا غُلٰمٌ ؕ وَاَسَرُّوْهُ بِضَاعَۃً ؕ  وَاللهُ عَلِیْمٌۢ بِمَا یَعْمَلُوْنَ○


অর্থঃ একটি কাফেলা এলো। অতঃপর তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করলো। সে নিজের বালতি ফেললো। বললো, কী আনন্দের কথা! এ তো একটি কিশোর! (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ১৯)


অপ্রত্যাশিতভাবে কূপের তলদেশ থেকে ভেসে ওঠা এই অল্প বয়স্ক অপরূপ ও বুদ্ধিদীপ্ত বালককে দেখে মালেক ইবনে দোবর চিৎকার করে উঠলেন। মুসলিম শরীফে মিরাজ রজনীর হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ইউসুফ আ. এর সাথে সাক্ষাতের পর দেখলাম যে, আল্লাহ তা‘আলা সমগ্র বিশ্বের রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেক তাঁকে দান করেছেন এবং অবশিষ্ট অর্ধেক সমগ্র বিশ্বে বণ্টন করা হয়েছে। 


কাফেলার লোকেরা তখন তাঁকে একটি মূল্যবান পণ্য মনে করে গোপন করে ফেললো। আয়াতের পরবর্তী অংশে সে কথা বলা হয়েছে,


وَاَسَرُّوْهُ بِضَاعَۃً ؕ

অর্থঃ তারা ব্যাবসায়িক পণ্যরূপে তাকে গোপন করে ফেললো।


শুরুতে তো মালেক ইবনে দোবর এ কিশোরকে দেখে অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন। কিন্তু পরে চিন্তাভাবনা করে স্থির করলেন যে, এটা জানাজানি না হওয়া উচিত এবং গোপন করে ফেলা দরকার, যাতে একে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ লাভ করা যায়।


অথবা এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা ঐ মুহূর্তে সেখানে এসেছিল। তারা বাস্তব ঘটনা গোপন করে তাঁকে পণ্যদ্রব্য করে নিলো। যেমন, কোনো কোনো রিওয়ায়েতে আছে যে, ইয়াহুদা প্রত্যহ ইউসুফ আ. কে কূপের মধ্যে খানা পৌঁছানোর জন্য যেতো। তৃতীয় দিন তাঁকে কূপের মধ্যে না পেয়ে সে ফিরে এসে ভাইদের কাছে ঘটনা বর্ণনা করলো। অতঃপর সকল ভাই একত্রে সেখানে পৌঁছলো এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর কাফেলার লোকদের কাছ থেকে ইউসুফকে বের করলো। তখন তারা বললো, এ বালকটি আমাদের গোলাম, পলায়ন করে এখানে এসেছে। তোমরা একে কবজায় নিয়ে খুব খারাপ কাজ করেছো। 


একথা শুনে মালেক ইবনে দোবর ও তার সঙ্গীরা ভীত হয়ে গেল যে, তাদেরকে চোর সাব্যস্ত করা হবে। তাই ভাইদের সাথে তাকে ক্রয় করার ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে লাগলো। 


এমতাবস্থায় আয়াতের অর্থ এই হবে যে, ইউসুফের ভাইয়েরা, নিজেরাই ইউসুফকে পণ্যদ্রব্য স্থির করে বিক্রি করে দিলো। ইউসুফ আ. এর মতো একজন মহাপুরুষের সঠিক মূল্য সম্পর্কে ভাইয়েরা ছিল অজ্ঞ। আর তাছাড়া ইউসুফ আ. এর ভাইদের আসল উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন ছিল না। আসল উদ্দেশ্যতো ছিলো পিতার কাছ থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। তাই তারা তাঁকে গুটি কতেক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল।


নিম্নেবর্ণিত আয়াতে এ কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে, 


وَشَرَوْهُ بِثَمَنٍۭ بَخْسٍ دَرَاهِمَ مَعْدُوْدَۃٍ ۚ وَکَانُوْا فِیْهِ مِنَ الزَّاهِدِیْنَ○


অর্থঃ তারা তাকে বিক্রি করে দিল অতি অল্পমূল্যে-গুণাগুণিত কয়েক দিরহামে। আর তারা ছিল তাঁর ব্যাপারে নিরাসক্ত। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ২০)


কাফেলার লোকেরা তাঁকে মিসর নিয়ে গেলেন। সেখানে নেয়ার পর ইউসুফ আ. কে বিক্রয়ের কথা ঘোষণা করতেই ক্রেতারা প্রতিযোগিতামূলক ভাবে দাম বলতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইউসুফ আ. এর ওজনের সমান স্বর্ণ, সমপরিমাণ মৃগনাভি ও সমপরিমাণ রেশমি বস্ত্র দাম সাব্যস্ত হলো।


ইউসুফ আ. এর স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা

 ইউসুফ আ. এর স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা


হযরত ইউসুফ আ. শৈশবে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, এগারটি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চাঁদ তাকে সিজদা করছে। এই অভিনব স্বপ্ন দেখে পিতার নিকট ব্যক্ত করলে তিনি নবী সুলভ দূরদর্শীতা দিয়ে বুঝতে পারলেন যে, ইউসুফের ভবিষ্যতে মহা মর্যাদা অপেক্ষা করছে। এমনকি সে নবীও হতে পারে। তাই তিনি তাকে আরো অধিক স্নেহ করতে লাগলেন এবং তার এই সৌভাগ্যের সংবাদ অবহিত হয়ে অন্যান্য ভায়েরা তার প্রতি আরো ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতে পারে এবং তাকে কষ্ট দেয়ার পরিকল্পনা করতে পারে ভেবে তিনি ইউসুফকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন যে, তোমার ভাইদের নিকট এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত মোটেও বর্ণনা করো না, তাহলে তোমার বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠবে। কেননা শয়তান তো মানুষের চিরশত্রু । সে চায়না ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক অটুট থাকুক, শান্তিতে বসবাস করুক। কিন্তু মানুষ যেটা আশংকা করে সেটাই হয়ে থাকে। 


হযরত ইউসুফ আ. এর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা দেখলো যে, পিতা ইয়াকূব আ. ইউসুফের প্রতি অসাধারণ মুহাব্বত রাখেন। ফলে তাদের মনে হিংসা মাথা চড়া দিয়ে ওঠে। এটাও হতে পারে যে, তারা কোনোভাবে ইউসুফ আ. এর স্বপ্নের বিষয়ও জানতে পেরেছিলো, যদ্দরূণ তারা হযরত ইউসুফ আ. এর বিরাট মাহাত্ম্যের কথা টের পেয়ে তাঁর প্রতি হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলো।


তখন তারা পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলো যে, আব্বাজান দেখি আমাদের তুলনায় ইউসুফ ও তার ছোট ভাই বিনয়ামীনকে অধিক ভালোবাসেন। অথচ আমরা দশজন তাদের বড় হওয়ার কারণে ঘরের কাজ-কর্ম করতে সক্ষম। তারা উভয়েই ছোট বালক বিধায় ঘরস্থালির কাজ করার শক্তি রাখে না। আমাদের পিতার উচিৎ হলো, বিষয়টি অনুধাবন করা এবং আমাদেরকে অধিক মুহাব্বত করা। কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে অবিচার করে যাচ্ছেন। তাই এসো, আমরা হয় ইউসুফকে হত্যা করি, না হয় তাকে এমন দূরদেশে নির্বাসিত করি, যেখান থেকে সে আর ফিরে আসতে না পারে।


হযরত ইউসুফ আ. এর ঘটনা ও শিক্ষা

 হযরত ইউসুফ আ. এর ঘটনা ও শিক্ষা


আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন, 


لَقَدْ کَانَ فِیْ یُوسُفَ وَ اِخْوَتِهٖۤ اٰیٰتٌ لِّلسَّآئِلِیْنَ○ اِذْ قَالُوْا لَیُوْسُفُ وَ اَخُوْهُ اَحَبُّ اِلٰۤی اَبِیْنَا مِنَّا وَنَحْنُ عُصْبَۃٌ ؕ اِنَّ اَبَانَا لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنِۣ○ اقْتُلُوْا یُوْسُفَ اَوِاطْرَحُوْهُ اَرْضًا یَّخْلُ لَكُمْ وَجْهُ اَبِیْكُمْ وَتَكُوْنُوْا مِنْۢ بَعْدِهٖ قَوْمًا صٰلِحِیْنَ○ قَالَ قَآئِلٌ مِّنْهُمْ لَا تَقْتُلُوْا یُوْسُفَ وَاَلْقُوْهُ فِیْ غَیٰبَتِ الْجُبِّ یَلْتَقِطْهُ بَعْضُ السَّیَّارَۃِ اِنْ كُنْتُمْ فٰعِلِیْنَ○


অর্থঃ ইউসুফ আ. ও তার ভাইদের কাহিনীতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে প্রশ্নকারীদের জন্য; যখন তারা বললো, অবশ্যই ইউসুফ ও তার ভাই আমাদের পিতার কাছে আমাদের চাইতে অধিক প্রিয়, অথচ আমরা একটি সংহত দল। নিশ্চয় আমাদের পিতা প্রকাশ্য ভ্রান্তিতে রয়েছেন। হয়তো ইউসুফকে হত্যা করো কিংবা তাকে ফেলে রেখে আসো অন্য কোন স্থানে। তাহলে তোমাদের পিতার নেকদৃষ্টি শুধু তোমাদের প্রতিই নিবিষ্ট হবে এবং এরপর তোমরা (তাওবা করে) ভাল মানুষ হয়ে যাবে। তাদের মধ্য থেকে একজন বললো, তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো না, বরং যদি তোমরা কিছু করতেই চাও, তাহলে তাকে কোনো কূপের গভীরে নিক্ষেপ করো, যাতে কোন পথিক তাকে তুলে নিয়ে যায়। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৭-১০)


উল্লিখিত আয়াতসমূহে হযরত ইউসুফ আ. ও তাঁর ভাইদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। হযরত ইউসুফ সহ হযরত ইয়াকূব আ. এর বারো জন পুত্র সন্তান ছিলেন। তাদের প্রত্যেকেরই অনেক সন্তান-সন্ততি হয় এবং বংশ বিস্তার লাভ করে।



ইউসুফ আ. এর পরিচয়


হযরত ইয়াকূব আ. এর উপাধি ছিল ইসরাঈল। তাই সেই বারটি পরিবার সবাই ‘বনী ইসরাঈল’ নামে পরিচিত হয়। বারো ছেলের মধ্যে দশজন বড়ছেলে হযরত ইয়াকূব আ. এর প্রথমা স্ত্রী লাইয়্যা বিনতে লাইয়্যানের গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মৃত্যুর পর ইয়াকূব আ. লাইয়্যার বোন রাহীলকে বিবাহ করেন। রাহীলের গর্ভে দুই ছেলে ইউসুফ ও বিনয়ামীন জন্মগ্রহণ করেন। 


তাই হযরত ইউসুফ আ. এর একমাত্র সহোদর ভাই ছিলেন বিনয়ামীন এবং অবশিষ্ট দশজন বৈমাত্রেয় ভাই। এরপর ইউসুফ আ. এর আম্মা রাহীলও বিনয়ামীনের জন্মের সময় মৃত্যুমুখে পতিত হন। (আল-জামি‘লিআহকামিল কুরআন লিল কুরতুবী)