Tuesday, April 11, 2023

আহলে হাদীস নাম ইংরেজ সরকারের অবদান

 আহলে হাদীস নাম ইংরেজ সরকারের অবদান


শুরুর দিকে এ দলটি নিজেদেরকে মুহাম্মাদী, সালাফী, লা-মাযহাবী, ওয়াহাবী, আছারী ইত্যাদি বলে পরিচয় দিত। কিন্তু এসব পরিচয়ে তারা তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। তাই বাটালবী সাহেব ইংরেজ সরকার বরাবর দরখাস্ত করলেন “আমার সম্পাদিত এশায়াতুস সুন্নাহ পত্রিকায় ১৮৮৬ইং সনে প্রকাশ করেছিলাম যে, ওয়াহাবী শব্দটি ইংরেজ সরকারের নিমকহারাম ও রাষ্ট্রদ্রোহীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ শব্দটি হিন্দুস্তানের মুসলমানদের ঐ অংশের জন্য ব্যবহার করা সমীচীন হবে না যাদেরকে আহলে হাদীস বলা হয় এবং যারা সর্বদা ইংরেজ সরকারের নিমকহালালী, আনুগত্য ও কল্যাণই কামনা করে যা বারবার প্রমাণিতও হয়েছে এবং সরকারী চিঠি-পত্রেও এর স্বীকৃতি আছে। অতএব এ দলের প্রতি ওয়াহাবী শব্দ ব্যবহারের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে এবং গভর্নমেন্ট বরাবর অত্যন্ত আদব ও সবিনয় নিবেদন করা যাচ্ছে যে, সরকারীভাবে এই ওয়াহাবী শব্দ রহিত করে আমাদের উপর তা প্রয়োগের নিষেধাজ্ঞা জারী করা হোক। -আপনার অনুগত আবূ সাঈদ মুহাম্মাদ হুসাইন, সম্পাদক এশায়াতুস সুন্নাহ”।


অনুগত বান্দার এ আবেদনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নর দফতর থেকে “তার দরখাস্ত মঞ্জুর করা হল এবং তাদের জন্য আহলে হাদীস নাম সরকারীভাবে বরাদ্দ করা গেল”-মর্মে চিঠি পাঠানো হয়। সরকারের তরফ থেকে পাঠানো সেসব চিঠির তালিকা লক্ষ্য করুন- পাঞ্জাব গভর্নর সেক্রেটারি মি. ডব্লিউ এম এন- চিঠি নং ১৭৫৮, সি পি গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ৪০৭, ইউ পি গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ৩৮৬, বোম্বাই গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ৭৩২, মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ১২৭, বাঙ্গাল গভর্নমেন্ট- চিঠি নং ১৫৫ (সূত্র: এশায়াতুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা ৩২-৩৯, সংখ্যা ২, খণ্ড ১১)।


আহলে হাদীস খেতাব বরাদ্দ পেয়ে বাটালবী সাহেব দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে হাদীস মানার নামে মুসলমানদেরকে গোমরাহ করেন। এ কাজে তিনি নিজের সবটুকু শ্রম-সাধনা ইংরেজের সন্তুষ্টি অর্জনে বিলিয়ে দেন। তারপর কুদরতের কারিশমা দেখুন, পঁচিশ বছর পর সেই এশায়াতুস সুন্নাহ পত্রিকায় সেই মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালবী লিখলেন ‘যে ব্যক্তি ঈমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যেতে চায় তার জন্য সহজ পথ হল, তাকলীদ (মাযহাবের ইমামের অনুসরণ) ছেড়ে দেয়া।’ (সূত্র: এশায়াতুস সুন্নাহ, খণ্ড ১১, সংখ্যা ২, পৃষ্ঠা ৫৩)। এ যেন নিজের হাঁড়ি নিজেই হাটে ভাঙ্গার নামান্তর।


বাটালবী সাহেব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ইংরেজের সেবা করে গেছেন। ইতিহাস এর সাক্ষ্য বহন করে। তিনি মরে গেছেন কিন্তু তার বই-পুস্তক আর ভ্রান্ত মতবাদ আজও রয়ে গেছে। সেগুলোর মাধ্যমে এখনো হাজার হাজার মুসলমান গোমরাহ হচ্ছে।



Sunday, April 9, 2023

ইসলামী খিলাফত ধ্বংসের কাহিনী

 ইসলামী খিলাফত ধ্বংসের কাহিনী


ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা ধ্বংসের লোমহর্ষক কাহিনীঃ


মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের পর ইসলাম এবং মুসলমানদের শক্তি ও শান্তি শৃঙ্খলার উৎস ছিল নিযামে খিলাফাত বা সুপ্রতিষ্ঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক খিলাফত ব্যবস্থা। সেই ধারাবাহিকতায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তিকালের পর সর্বপ্রথম খলীফা মনোনীত হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.।


তাঁর পর খলীফা নিযুক্ত হন হযরত উমর রাযি. এই দুই খলীফার কালজয়ী আদর্শ শাসনে ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও সফলতা যখন পরিস্ফুটিত ও সু-প্রমাণিত হয়ে প্রকাশ পায় তখনই ইয়াহুদী খৃষ্টান চক্র তাদের সকল ষড়যন্ত্রের মূল টার্গেট বানায় ‘নিযামে খিলাফাত’ কে। নতুন করে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে মুসলিম উম্মাহর উন্নতি ও অগ্রগতির মূল শক্তি খিলাফত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার দুরভিসন্ধিতে ইসলামের তৃতীয় খলীফা আমীরুল মু’মিনীন হযরত উসমান যিন্নুরাইন রাযি. এর খিলাফতকালের প্রাথমিক পর্যায়ে হিজরী ২৫ সনে ছদ্মবেশ ধারণ করে মুসলমান দলভুক্ত হয় আব্দুল্লাহ বিন সাবা নামে এক কুখ্যাত ইয়াহুদী মুনাফিক।


এসময় হযরত উসমান রাযি. এর নেতৃত্বে পারস্য, মিশর, সিরিয়া ও ইরাক ইত্যাদি অঞ্চল বিজিত হওয়ার পর লক্ষ লক্ষ লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করার হিড়িক চলছিল। এর মধ্য আব্দুল্লাহ বিন সাবা ছাড়াও তার মত আরো অনেক সংখ্যক মুনাফিক ইসলামের মূলে আঘাত হানার মানসে বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করে।


Thursday, April 6, 2023

আখিরী নবী ﷺ এর কতিপয় গুণাবলী

 আখিরী নবী ﷺ এর কতিপয় গুণাবলী


আয়াতটির আলোকে আখিরী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর কতিপয় গুণাবলী আলোচ্য আয়াতটিতে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহের উদ্ধৃতি দিয়ে আখিরী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর  যে সকল গুণাবলীর অবতারণা করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ:


ক) আখিরী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল বলে সম্বোধন করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সোয়া লক্ষ আম্বিয়ায়ে কিরামের আ. মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা মাত্র তিন শত তের জনকে রাসূলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। নবী ও রাসূলের মধ্যে মর্যাদা ও বিধানগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। রাসূলগণের মর্তবা সাধারণ নবীগণের ঊর্ধ্বে। সংজ্ঞা হিসেবে নবী বলতে বুঝায় যিনি আল্লাহর পয়গাম বান্দাদের নিকট পৌছিয়ে থাকেন। তাঁর উপর স্বতন্ত্র কিতাব নাযিল হওয়া বা তাঁকে নতুন শরী‘আত প্রদান করা শর্ত নয়। অপর দিকে রাসূল বলা হয়, এরূপ দীন প্রচারক নবীকে; যাঁকে নতুন কিতাব ও নতুন শরী‘আত প্রদান করা হয়েছে । অথবা কোন কাফির সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করা হয়েছে। সেই স্বতন্ত্র আসমানী কিতাব ও নতুন শরী‘আত প্রাপ্ত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী নবী-রাসূলগণের মধ্যে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ তা‘আলা  তাঁকে “সাইয়্যিদুল মুরসালীন বা রাসূলগণের সরদার” মনোনীত করেছেন।



Wednesday, April 5, 2023

ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর অবদান

 ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর অবদান


ইসলামী শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় যেমনঃ তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, মাগাযী ইত্যাদির শুরু ও সুচনা যদিও ইসলামের প্রারম্ভ থেকে হয়েছিল তবুও যত দিন পর্যন্ত সেগুলো একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করেনি, তত দিন পর্যন্ত তার সঙ্গে কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম যুক্ত হয়নি। সে হিসেবে হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ফিকহশাস্ত্রের সঙ্গেও কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম যুক্ত হয়নি। হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ইমাম আবূ হানীফা নু’মান ইবনে সাবেত রহ.-এর সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিরলস চেষ্টা সাধনায় ফিকহশাস্ত্র পূর্ণতা লাভ করে এবং একটি সতন্ত্র বিদ্যায় রূপ নেয়। এজন্য ইমাম আবূ হানীফা রহ. ফিকহ আবিষ্কারক হিসেবে ভূষিত হন। ড. ফিলিপ হিট্টির ভাষায়ঃ


الاما م ابو حنيفة الذى وضع الاساس لاول مدارس شرع الاربع فى الاسلام.


অর্থঃ “আবূ হানীফা রহ. সেই ব্যক্তি, যিনি ইসলামে সর্বপ্রথম ফিকহ শরী‘আর ভিত্তি স্থাপন করেন।”


অর্থাৎ আবূ হানীফা রহ. সহীহ হাদীসের আলোকে ইস্তিমবাত, ও গবেষণার মাধ্যমে ফিকহে ইসলামীকে এমন পূর্ণতা ও সামগ্রিকতা দান করেন যে, তিনি ফিকহে ইসলামীর মূল ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হন। তিনি যেমন ঘটিত বিষয়ে ফাতাওয়া ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি সম্ভাব্য ও ঘটিতব্য মাসআলার ফাতাওয়া ভাণ্ডারও গড়ে তুলেছিলেন। ফলে তার ফাতাওয়া ভাণ্ডার বিশাল আকার ধারণ করেছিল। আবূল ফজল কিরমানী তার ইরশাদুল মারাম গ্রন্থে বলেন,-“আবূ হানীফা রহ.-এর মাসআলার সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো” আল্লামা আইনী রহ. তার ইনায়া গ্রন্থে বলেন, “আবূ হানীফা রহ.-এর মাসআলা বারো লাখ সত্তর হাজারের কিছু বেশি।” এর দ্বারা অনুমান করা যায় কী বিশাল ফিকহী ভাণ্ডারই না তিনি গড়ে তুলেছিলেন। আর এ কারণেই পরবর্তী সকল ফিকহ ও মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে আবূ হানীফা রহ.-এর ফিকহকে পুঁজি করে।


উদাহরণতঃ শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম হলেন ইমাম শাফেয়ী রহ.। তিনি ফিকহ শিখেছেন ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর নিকট থেকে। আর ইমাম মুহাম্মাদ রহ. ছিলেন ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর প্রথম সারির শিষ্য। মালেকী মাযহাবের প্রবর্তক হলেন, ইমাম মালেক রহ.। তিনিও আবূ হানীফা রহ.-এর ফিকহ থেকে বেশ উপকৃত হয়েছেন। কাযী আবূল আব্বাস মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ধারাবাহিক সনদে আব্দুল আযীয আদ দারা ওয়ারদী হতে বর্ণনা করেন, ‘ইমাম মালেক রহ. ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর কিতাবসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করতেন এবং তা থেকে উপকৃত হতেন।’ অন্য এক বর্ণনায় আছে আবূ হানীফা রহ. মদীনা সফরকালে ইমাম মালেক রহ. তাঁর সাথে মসজিদে নববীতে মিলিত হতেন তারপর তারা উভয়ে ইশার নামাযের পর থেকে ফজরের নামায পর্যন্ত ইলমী আলোচনায় মশগুল থাকতেন। (ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনে আবিল আওয়াম-১০৩)


হাম্বলী মাযহাবের প্রবর্তক ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. ফিকহ ও হাদীস হাসিল করেছেন ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. থেকে। যাদের ফিকহের ভিত্তি ছিল ফিকহে আবূ হানীফা রহ.। হাফেয আবূল ফাতাহ সাইয়িদুন নাস ‘উয়ূনুল আসার’ গ্রন্থে লিখেন, “হযরত আব্দুল্লাহ আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, আমার পিতা (আহমাদ ইবনে হাম্বল) ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ রহ. থেকে তিন তাক পরিমাণ ইলমে শরী‘আহ লিপিবদ্ধ করেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি সেগুলো অধ্যয়ন করতেন? আব্দুল্লাহ বললেন, মাঝে মাঝে অধ্যয়ন করতেন।” (আরো দেখুন বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ১০/৩৪৭)


এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, আবূ হানীফা রহ.-এর পর হতে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মুহাদ্দিস ও ফকীহের আগমন ঘটেছে তারা সকলেই কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং কোন না কোন ইমামের ফিকহের আলোকে জীবন যাপন করেছেন। সুতরাং পরবর্তী সকল মুহাদ্দিস ও ফকীহ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর ফিকহের কাছে ঋণী। এমন কি এ কথা বলাও অতিরঞ্জন হবে না যে, ইমাম সাহেব পরবর্তী গোটা মুসলিম যাহান তাঁর ও তাঁর ফিকহের কাছে চিরঋণী। ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর বিখ্যাত উক্তিটি লক্ষ করুন, মাযহাবের একজন মান্যবর হওয়া সত্ত্বেও তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন- الناس عيال ابي حنفة في الفقه


“ফিকহ বিষয়ে সকল মানুষ আবূ হানীফা রহ.-এর কাছে দায়বদ্ধ। (তারীখে বাগদাদ ১৩/৩৪৬; সিয়ারু আ’লামিন নবালা ৬/৪০৩, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪৫০)


তিনি আরও বলেছেন,


 ما طالب احد الفقه الا كان عيالا على ابي حنفة  


“যে কেউ ফিকহ অন্বেষণ করবে তাকে আবূ হনীফার কাছে দায়বদ্ধতা স্বীকার করতেই হবে। (ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনে আবিল আউয়াম ৭)


ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর ফিকহ আহোরণ ও সংকলন পদ্ধতিঃ


ইমাম আবূ হানীফা রহ. কীভাবে ফিকহ আহরণ করতেন তা স্বয়ং তার যবানীতেই শুনুন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সহীহ সনদে ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর  যে 


নীতিগুলো উল্লেখিত হয়েছে তার সারকথা এই-


১। মাসআলার সমাধান যখন কিতাবুল্লাহতে পাই তখন সেখান থেকেই সমাধান গ্রহণ করি।


২। সেখানে না পেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও সহীহ হাদীস থেকে গ্রহণ করি, যা নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সহীহ হাদীস আমাদের শিরোধার্য, একে পরিত্যাগ করে অন্য কিছুর শরনাপন্ন হওয়ার প্রশ্নই আসে না। 


৩। এখানে যদি না পাই তাহলে সাহাবায়ে কেরামের সিদ্ধান্তগুলোর শরণাপন্ন হই।


৪। কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতু রাসূল্লিল্লাহ ও ইজমায়ে সাহাবার সামনে কিয়াস চলতে পারে না। তবে যে বিষয়ে সাহাবীদের একাধিক মত রয়েছে সেখানে ইজতিহাদের মাধ্যমে যে মত কুরআন-সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী বলে বোধ করি তা গ্রহণ করি।


৫। মাসআলার সমাধান এখানেও পাওয়া না গেলে ইজতিহাদের মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছে থাকি। তবে এ ক্ষেত্রেও তাবেয়ীগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হই না। (আল ইনতিকা ফী ফাযাইলিল আইম্মাতিছ ছালাছাতিল ফুকাহা, ইবনে আব্দিল বার ১২/২১৬-২৬৪, ফাযাইলু আবী হানীফা আবূল কাসিম ইবনু আবিল আউয়াম ২১-২৩, মাখতুত: আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহী, আবূ আব্দুল্লাহ আস সাইমারী (মৃত্যু ৪৩৬ হি.) পৃষ্ঠা : ১০-১৩, তারিখে বাগদাদ ১৩/৩৬৮, মানাকিবুল ইমাম আবূ হানীফা, মুয়াফফাক আল মক্কী ১/৭৪-১০)


ফিকহে মুতাওয়ারাস এর সংকলন এবং ফিকহে জাদীদে আহরণের যে নীতিমালা ইমাম সাহেবের নিজের ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে তা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের সকল ইমামের সর্বসম্মত নীতি। কোন ফিকহ তখনই ইসলামী ফিকহ হতে পারে যখন তা উপরোক্ত নীতিমালার ভিত্তিতে সংকলিত ও আহরিত হয়। ফিকহ সংকলন ও আহরণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত নীতিমালা অনুসরণে ইমাম সাহেব রহ. কতটুকু সফল হয়েছেন তা তার সমসাময়িক স্বীকৃত ইমামগণের বক্তব্য থেকে জানা যেতে পারে, যারা তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ইত্যাদি সকল ইসলামী শাস্ত্রের ইমাম ছিলেন, ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহ. (মৃত্যু-১৬১ হি.) বলেন, “আবূ হানীফা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইলম অন্বেষণ করেছেন। তিনি ছিলেন (দ্বীনের প্রহরী) দ্বীনের সীমানা রক্ষাকারী  যেন আল্লাহর হারামকৃত কোন বিষয়কে হালাল মনে করা না হয়। কিংবা হালালের মতো তাতে লিপ্ত না হয়। যে হাদীসগুলো তার কাছে সহীহ সাব্যস্ত হতো অর্থাৎ যা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিগণের সনদে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তা গ্রহণ করতেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসল্লাম-এর কর্ম থেকে যেটি সর্বশেষ সেটি গ্রহণ করতেন আর কুফার আলেমগণকে যে সকল হাদীসের উপর প্রতিষ্ঠিত দেখেছেন সে সকল হাদীসও তিনি গ্রহণ করতেন। (কেননা এটাই ছিল সাহাবা যুগ থেকে চলমান আমল ও ধারা) (আল ইনতিকা, ইবনে আব্দিল বার পৃষ্ঠা: ২৬২) ফিকহে হানাফীর ভিত্তিই যখন হাদীস ও সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত তখন হাদীস ও সুন্নাহর সঙ্গে এর সম্পর্ক কতখানি মজবুত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্যই ইমাম ইবনুল মুবারক রহ. বলেছেন, ‘আবূ হনীফার ফিকহকে শুধু রায় বলো না। কেননা তা হলো হাদীসের তাফসীর।’ (ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনু আবিল আওয়াম-২৩)


সংকলন পদ্ধতি:

১২০ হিজরীতে হাম্মাদ রহ. এর ইন্তেকালের পর ইমাম আবূ হানীফা রহ. তার আসনে সমাসীন হলেন। এদিকে ইসলামী সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল। ইবাদাত ও মু’আমালাত সম্পর্কিত বিষয়াদিতে এত মাসআলা দেখা দিল যে, এর সমাধানে আইনের একটি সুবিন্যস্ত সংকলন ছাড়া কিছুতেই কাজ চলছিল না। তাই ইমাম আবূ হানীফা রহ. ফিকহ সংকলনের ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু এই মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিতে একদল দক্ষ, কর্মঠ ও অভিজ্ঞ আলেমের প্রয়োজন ছিল। সে মতে তিনি তার অগণিত ছাত্রদের মধ্য হতে বাছাই করে চল্লিশ জন দক্ষ ও কর্মঠ ছাত্র নিয়ে ফিকহ বোর্ড গঠন করেন।


ইমাম ত্বহাবী রহ. আসাদ ইবনে ফুরাত হতে অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেন, “আবূ হানীফা রহ. এর যে সকল ছাত্র ফিকহ সংকলনের কাজ আঞ্জাম দেন তাদের সংখ্যা (৪০) চল্লিশ জন।” এরা হলেন-


১. কাযী আবূ ইউসুফ

২. ইমাম মুহাম্মাদ

৩. ইমাম যুফার

৪. ওয়াকী ইবনুল জাররাহ

৫. ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া

৬. আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক

৭. দাউদ ইবনে নুসাইর

৮. হাফস ইবনে গিয়াস

৯. ইউসুফ ইবনে খালিদ

১০. আফিয়া ইবনে ইয়াযিদ

১১. হিব্বান ইবনে আলী

১২. মুনদিল ইবনে আলী

১৩. আলী ইবনে মুসহীর

১৪. কাসীম ইবনে মা’আন

১৫. আসাদ ইবনে আমর

১৬. ফযল ইবনে মুসা

১৭. আলী ইবনে যারইয়ান

১৮. হিশাম ইবনে ইউসুফ

১৯. ইয়াহইয়া ইবনে সাইদ আল কাত্তান

২০. শুআইব ইবনে ইসহাক

২১. হাফস ইবনে আব্দুর রহমান

২২. হাকাম ইবনে আব্দুল্লাহ

২৩. খালিদ ইবনে সুলাইমান

২৪. আঃ হামিদ ইবনে আব্দুর রহমান

২৫. আবূ কাসেম যাহহাক ইবনে মাখলাদ

২৬. মাক্কী ইবনে ইবরাহীম

২৭. হাম্মাদ ইবনে দালীল

২৮. আব্দুল্লাহ ইবনে ইদরীস

২৯. ফুজাইল ইবনে ইয়ায

৩০. হাইসাম ইবনে বাশীর

৩১. নূহ ইবনে দাররাহ

৩২. যুহাইর ইবনে মুআবিয়া

৩৩. শরীক ইবনে আব্দুল্লাহ

৩৪. নসর ইবনে আব্দুল কারীম

৩৫. মালিক ইবনে মা’ফুল

৩৬. জাবীর ইবনে খাযিম

৩৭. জারীর ইবনে আব্দুল হামীদ

৩৮. হাসান ইবনে যিয়াদ

৩৯. হাম্মাদ ইবনে আবী হানীফা

৪০. আবূ ইসমাতা নূহ ইবনে মারয়াম


সংকলন পদ্ধতি ছিল এরূপ, বোর্ডের সামনে কোন একটি মাসআলা পেশ করা হতো। সবাই এ ব্যাপারে এক মত না হলে অত্যন্ত স্বাধীনভাবে বিতর্ক শুরু হয়ে যেতো। এই বিতর্ক কখনও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আবার কখনও কয়েকদিন পর্যন্ত চলত। ইমাম আবূ হানীফা রহ. ধ্যান ও ধৈর্য্য সহকারে সকলের বক্তব্য শুনতেন। সবশেষে তিনি এমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ ফায়সালা পেশ করেন যে, সকলেই তা মানতে বাধ্য হতো। আবার কখনও এরূপ হতো যে, ইমাম সাহেবের ফায়সালার পরও কেউ কেউ নিজ নিজ মতের উপর অটল থাকতেন। তখন ইমাম সাহেবের ফায়সালার পাশাপাশি ওই সব মতগুলোকেও লিপিবদ্ধ করে নেওয়া হতো। যতক্ষণ পর্যন্ত অধিকাংশ সদস্য কোন ব্যাপারে একমত না হতো ততক্ষন পর্যন্ত কোন মাসআলার ফায়সালা না করার বিধান ছিল। হাফেজ আবূল মাহাসেন রহ.- বলেন, এ সংকলনের বিন্যাস ছিল নিম্নরূপঃ


প্রথমে পবিত্রতার অধ্যায়, অতঃপর নামায ও রোযার অধ্যায়, তারপর ছিল ইবাদতের অন্যান্য অধ্যায়। অতঃপর মু’আমালাত ও লেনদেন এবং সর্বশেষে ছিল উত্তরাধিকারের অধ্যায়। পরবর্তীতে ইমাম মালেক রহ. ইমাম আবূ হানীফা রহ. সংকলিত ফিকহের এই বিন্যাস অনুযায়ী বিখ্যাত কিতাব মুয়াত্তা সংকলন করেন। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. এর বর্ণনা অনুযায়ী এটা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। তিনি লিখেন, “যে বৈশিষ্ট্যে ইমাম আবূ হানীফা রহ. একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী তা হল, তিনিই সর্ব প্রথম শরী‘আতের ইলমকে সংকলিত করেছেন এবং বিষয় ভিত্তিক বিন্যাসে অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ বিন্যস্ত করেছেন। এরপর ইমাম মালেক রহ. মুয়াত্তা গ্রন্থে তাঁর অনুসরণ করেছেন এবং সুফিয়ান সাওরীও তার গ্রন্থে ঐ নীতি অনুসরণ করেছেন। এ ব্যাপারে কেউ আবূ হনীফা রহ.-এর অগ্রবর্তী হতে পারেন নি।’


উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ সতর্কতা ও পূর্ণতার সঙ্গে ফিকহ সংকলনের কাজটি আঞ্জাম পেয়েছিল। যা হোক ইমাম সাহেবের জীবদ্দশাতেই এ সংকলন প্রকাশিত হয়ে সকলের নিকট সমাদৃত হয়। এমনকি সে সময় তার সমকক্ষের দাবীদার ব্যক্তিবর্গও তাঁর এ সংকলন থেকে উপকৃত হন।


যায়েদা বলেন, আমি সুফিয়ান সাওরী রহ.-এর শিয়রে একটি কিতাব দেখতে পেলাম যে কিতাবটি তিনি পাঠ করছিলেন। অনুমতি নিয়ে আমি কিতাবটি দেখতে লাগলাম। দেখি সেটা আবূ হানীফা রহ.-এর ‘কিতাবুর রেহেন’ (বন্ধক সংক্রান্ত মাসআলার সংকলন) আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আবূ হনীফার কিতাব পাঠ করছেন? তিনি বললেন, আফসোস যদি তাঁর সবগুলো রচনাই আমার কাছে থাকতো।” (হযরত আবূ হানীফা রহ., শিবলী নোমানী পৃ: ১৫৩ বাংলা অনুদিত)


এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, ফিকহ সংলন ও গ্রন্থনায় ইমাম সাহেবের কী প্রভাব-বিস্তারক অবদান রয়েছে। তাঁর এই অনবদ্য ও অতুলনীয় অবদানের কথা আজকের কতিপয় আহলে হাদীস বন্ধু অস্বীকার করলেও ইমাম বুখারী রহ.-এর দাদা উস্তাদ ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে দাউদ কুরাইবী যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বলেছেন, মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য হলো, নিজেদের নামাযে ইমাম আবূ হানীফার জন্য দু’আ করা। কেননা তিনি উম্মাহর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও ফিকহ সুরক্ষিত করে গিয়েছেন। 

Tuesday, April 4, 2023

ইমাম আবূ হানীফা রহ.এর শ্রেষ্ঠত্ব

 ইমাম আবূ হানীফা রহ.এর শ্রেষ্ঠত্ব


অনুসৃত চার মাযাহাবের মান্যবর চার ইমামের প্রত্যেকেই কুরআন-হাদীস সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ ছিলেন এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। তবে তুলনামূলক বিচারে ইমাম আবূ হনীফা রহ. ছিলেন তাদের সর্বশ্রেষ্ঠজন। ফিকহশাস্ত্র সংকলন ও এর প্রচার-প্রসারে তাঁর বিস্ময়কর অবদান সম্পর্কে ছিটেফোঁটা অবগতি থাকলেও ইনসাফপ্রিয় প্রতিটি মানুষ এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। ফিকহশাস্ত্রে তাঁর অবদানের কথা আলোচনার পূর্বে আমরা ফিকহশাস্ত্র ও এর ক্রমবিকাশ নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।


বস্তুতঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় শরী‘আতের বিধানাবলীর মান নির্ণীত ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সামনে উযু করতেন। মুখে বলতেন না যে, এটা ফরজ, এটা ওয়াজিব আর এটা মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে দেখে ঠিক সেভাবে উযু করতেন। নামাযের অবস্থাও ছিল তাই। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম ফরজ, ওয়াজিব ইত্যাদির বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিতেন না বা নেয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না। তাঁরা যেভাবে রাসূল ﷺ -কে নামায আদায় করতে দেখতেন হুবহু সেভাবেই নিজেরা নামায আদায় করতেন। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আমি কোন জাতিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবাদের চেয়ে উত্তম দেখিনি। কিন্তু তাঁরা নবীজীর গোটা জীবনে ‘তেরো’র অধিক মাসআলা জিজ্ঞেস করেননি। এর সবগুলোই আবার কুরআনে কারীমে বিদ্যমান। যে সমস্যাগুলো না জানলেই নয় সেগুলোই কেবল জিজ্ঞেস করতেন। (সুনানে দারেমী-মুকাদ্দিমা ১২৭) 


অনেক সময় এমন হতো যে, কেউ কোন কাজ করেছে, তিনি সেটাকে ভালো বলেছেন অথবা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এভাবে আদেশ নিষেধ সাধারণ সমাবেশে প্রকাশ পেত। আর সাহাবায়ে কেরাম সে পরিস্থিতিতে প্রদত্ত নবীজীর বক্তব্য স্মরণ রাখতেন। নবীজীর ইন্তেকালের পর ইসলামের বিজয় নিশান দূর-দুরান্তে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে সামাজিক জীবনের পরিধিও বর্ধিত হতে লাগল। সমস্যা এত বেশি ঘটতে লাগল যে, ইজতিহাদ ও মাসআলা আহরণের প্রয়োজন দেখা দিল। এতে কুরআন-হাদিসে বর্ণিত সংক্ষিপ্ত বিধি-নিষেধের বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রতি মনোযোগ দিতে হলো।


উদাহরণতঃ কেউ নামাযে ভুলক্রমে কোন আমল ছেড়ে দিল। এখন বিতর্ক এই দেখা দিল যে, তার নামায হলো কি হলো না,  তো এর সমাধান কল্পে নামাযের কার্যাবলির সবগুলোকেই ফরজ বলে দেয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই সাহাবায়ে কেরামকে নামাযের কার্যাবলির মান নির্ণয় করে নিতে হয়েছে যে, এই এই কাজ ফরজ, ওয়াজিব আর এগুলো সুন্নাত বা মুস্তাহাব। বলাবাহুল্য আমলগুলোর মান নির্ণয়ের এ ইজতিহাদ ও গবেষণায় যে মূলনীতি অনুসরণ করা হতো, সে ব্যাপারে সকল সাহাবীর একমত হওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্য মাসআলাসমূহে মতভেদ দেখা দিয়েছে এবং অধিকাংশ মাসআলায় সাহাবাদের মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া এরূপ অনেক ঘটনারও উদ্ভব ঘটেছে, যেগুলোর মূল ছিল নবীযুগে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা। এরূপ ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামকে মূল ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তার শাখা-প্রশাখা চিহ্নিত করে অতঃপর চলমান ঘটনাকে অনুরূপ ঘটনার সাথে সমন্বিত করে সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে। এই যে বিশ্বস্ত ও বিশেষজ্ঞ গবেষক কর্তৃক যথাযোগ্য পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কুরআন-হাদীসের ব্যবহারিক দিকটিকে উদ্ঘাটন ও আহরণ করা পরিভাষায় একে বলা হয় ইজতিহাদ। আর উদঘাটিত ও আহরিত মাসআলাকে বলা হয় ফিকহ। ফিকহ কুরআন-হাদীস বর্হিভুত কোনো বস্তু নয়; বরং কুরআন-হাদীসেরই ব্যবহারিক দিক।

Sunday, April 2, 2023

ব্যাংক ডিপোজিটের শরয়ী বিধান

 ব্যাংক ডিপোজিটের শরয়ী বিধান


ব্যাংকিং পরিভাষায় ব্যাংক ডিপোজিট চার প্রকারঃ


১. কারেন্ট একাউন্ট (Current Account)  বা চলতি হিসাব।


২. সেভিংস একাউন্ট (Savings Account )  বা সঞ্চয়ী হিসাব।


৩. ফিক্সড একাউন্ট (Fixed Deposit)  বা নির্ধারিত মেয়াদি সঞ্চয়।


৪.লকার (Locker)  তথা ব্যাংক থেকে লোহার বক্স ভাড়া নিয়ে তাতে টাকা পয়সা বা মূল্যবান সামগ্রী রেখে তা ব্যাংকের নিকট আমানত রাখা। (ফিকহী মাকালাত ৩/১৩-১৫)


ব্যাংক ডিপোজিটগুলোর শরয়ী অবস্থানঃ


প্রথম তিন প্রকার করজের হুকুমে দুটি শর্তের কারণেঃ


এক. এই তিন প্রকারের (কারেন্ট, সেভিংস ও ফিক্সড) ডিপোজিটারগণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে তাদের অর্থের যামিন বা জিম্মাদার বানায়। 


দুই. ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে তাদের গচ্ছিত অর্থের যথেচ্ছা ব্যবহারের সার্বিক ক্ষমতা প্রদান করে থাকে।


চতুর্থ প্রকার তথা লকার (Locker) এটা বর্তমান প্রচলন ও শরয়ী দৃষ্টিকোণ উভয় বিবেচনায় আমানত হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। (ফিকহী মাকালাত ৩/১৮)


সাধারণ ব্যাংগুলোতে অর্থ রাখার শরয়ী হুকুমঃ


১. জান ও মালের নিরাপত্তার খাতিরে কারেন্ট একাউন্টে টাকা রাখা জায়িয আছে। যেহেতু কারেন্ট একাউন্ট হোল্ডারদেরকে ব্যাংক কর্তৃক কোন মুনাফা প্রদান করা হয় না। বরং তাদের থেকে উল্টা সার্ভিস চার্জ ও অন্যান্য চার্জ কাটা হয়। অতএব, কারেন্ট একাউন্টে টাকা রাখলে সুদি লেন-দেনে অংশগ্রহণ গণ্য হবে না। সুতরাং তা জায়িয আছে।


২.ফিক্সড ডিপোজিট ও সেভিংস একাউন্টে টাকা রাখা জায়িয নেই। কারণ এই উভয় প্রকার একাউন্ট হোল্ডারদেরকে ব্যাংক কর্তৃক মুনাফা প্রদান করা হয় এবং এই উভয় একাউন্টে গচ্ছিত টাকা উম্মতের ঐক্যমতে করজের হুকুমে। আর করজের বিনিময়ে লাভ হাসিল করা শরীয়তে সূদ। অতএব ব্যাংক একাউন্ট হোল্ডারদেরকে মূল টাকার অতিরিক্ত যে টাকাই প্রদান করবে তা স্পষ্ট সূদ হবে। আর সূদ বৈধ হওয়ার কোন সুরত নেই।


সুতরাং যে ব্যক্তি উল্লেখিত একাউন্টে টাকা রাখবে সে ব্যাংকের সাথে হারাম লেন-দেনে শরীক হয়ে যাবে। এ কারণে কোন মুসলমানের জন্য এই দুই প্রকার (সেভিংস এবং ফিক্সড ডিপোজিট) একাউন্টে টাকা রাখা জায়িয নেই । কেউ রেখে থাকলে সুযোগ থাকলে সে একাউন্ট পরিবর্তন করে চলতি হিসাব খুলে সেখানে টাকা রাখবে। আর যদি কোন কারণে চলতি হিসাব খুলতে অপারগ হয় এবং জান ও মালের নিরাপত্তার জন্য সেভিংস একাউন্ট খুলতে বা জারী রাখতে বাধ্য হয়, তাহলে সে ইস্থিগফার করতে থাকবে এবং ঐ একাউন্টে যে সূদ আসবে তা সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া মিসকিনদেরকে বা মসজিদ মাদরাসার বাথরুম নির্মাণের জন্য (কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে) দিয়ে দিবে।


ইসলামী ব্যাংকগুলোর হুকুমঃ


ইসলামী ব্যাংক একটি মহত উদ্যোগ। উদ্যোক্তাদের আমরা ধন্যবাদ জানাই। যদি এটিকে তারা পূর্ণ ইসলাম অনুযায়ী পরিচালনা করেন। যার জন্য জরুরী হলো;


(ক) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই মর্মে অনুমতি না নিয়ে থাকলে অনুমতি নিবে যে, ব্যাংক সরাসরি নিজে বাণিজ্যিক মাল আমদানি ও রপ্তানি করবে। 


(খ) প্রত্যেক শাখার কারবার প্রত্যক্ষ করার জন্য একজন বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন থাকবে এবং সর্বময় কর্তৃত্ব ম্যানেজারের নয়, মজলিসে শূরার হাতে থাকবে। (ইসলাম আওড় জাদীদ মায়ীশাত পৃ. ১২৬)


১. ইসলামী ব্যাংকের কারেন্ট একাউন্ট সাধারণ ব্যাংকের কারেন্ট একাউন্টের মত জায়িয আছে।


২. ইসলামী ব্যাংকগুলো সেভিংস এবং ফিক্সড ডিপোজিটারদের সাথে টাকা বিনিয়োগের বিভিন্ন ব্যবসায়িক খাত দেখিয়ে যে চুক্তি করে থাকে তাকে শরিয়তের পরিভাষায় আকদে মুযারাবাহ বলে। আর ডিপোজিটারদের পরস্পরের মাঝে হয় আকদে মুশারাকাহ বা অংশীদারিত্বের চুক্তি। যারা সকলে মিলে তাদের অর্থ ও শ্রম ব্যাংকের নিকট সোপর্দ করেছে লাভ-লোকসানের মধ্যে শরীক হওয়ার ভিত্তিতে। ব্যাংক তাদেরকে নির্দিষ্ট পার্সেন্টিস হিসেবে লাভ দিবে। আর ক্ষতি হলে মুনাফা দ্বারা তা পূরণ করা সম্ভব না হলে ডিপোজিটারকেও তার অংশ অনুপাতে লোকসানের বোঝা নিতে হবে। বাস্তবে এমনটি হলে তা জায়িয হবে। কিন্তু সরেজমিনে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ইসলামী ব্যাংকগুলো সূদী ব্যাংকগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে সূদী লেন-দেনের সাথেই বেশী জড়িত। তারা মুখে মুখে হালাল মুনাফা প্রদানের কথা বললেও সহীহ তরীকায় ইনভেস্ট করে না তথা বেচা-কেনার মধ্যে শরীয়ত যে-সব শর্ত আরোপ করেছে তা সঠিকভাবে রক্ষা করে না। খাতা কলমে ঠিক দেখালেও বাস্তবে করে খামখেয়ালী এবং জনবল না থাকার দোহাই দিয়ে থাকে যা অগ্রহণযোগ্য। 


তাই প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলোতেও সেভিংস এবং ফিক্সড ডিপোজিট একাউন্ট খোলা জায়িয হবে না। যতক্ষণ না তারা তাদের কার্যক্রম বাস্তব ক্ষেত্রেও শরয়ী পন্থায় নিয়ে আসে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতায় তাদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ শরীয়ত ভিত্তিক প্রমাণ করতে না পারে। (আল মাবসূত লিস্ সারাখসী ২২/১৩৩)


অমুসলিম দেশের ব্যাংকের হুকুমঃ

অমুসলিম দেশের অমুসলিম মালিকদের ব্যাংক কর্তৃক প্রদেয় সূদ গ্রহণের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরামের সমর্থন রয়েছে। যেহেতু তারা এই টাকা মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করে এবং এর মাধ্যমে তারা মুসলমানদেরকে দুর্বল করার বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে। কাজেই সূদের টাকা ব্যাংকে না ছেড়ে উঠিয়ে নিবে। তার পর সাওয়াবের নিয়ত না করে মিসকিনদেরকে দিয়ে দিবে। (ফিকহী মাকালাত ৩/২২)


সূদী টাকার হুকুমঃ

যারা শরয়ী বিধান না জানার কারণে শরীয়ত বিরোধী পন্থায় লেন-দেন করার কারণে কিছু সূদী টাকা তার মালিকানায় চলে এসেছে কিংবা ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শরী‘আতের বিধি-বিধানের পাবন্দি ছিলনা। কিন্তু এখন সে তাওবা করে সূদ থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছে, তারা সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া ঐ টাকা ফকীর-মিসকিন অথবা কোন কল্যাণকর কাজে ব্যয় করে দিবে। (ফিকহী মাকালাত ৩/২২)

Friday, March 31, 2023

সম্মিলিত মুনাজাতের শরয়ী বিধান

 সম্মিলিত মুনাজাতের শরয়ী বিধান


ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতের শরয়ী বিধানঃ


আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন: ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। নিশ্চয় যারা অহংকার বশত: আমার ইবাদত (অর্থাৎ আমার কাছে দু‘আ করা) থেকে বিমুখ হয় বা মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সুরা মুমিনঃ৬০, তাফসীরে ইবনে কাছীর:৭/১৫৩)


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘নিশ্চয় দু‘আ ইবাদত।’  (মুসনাদে আহমাদ হা. নং ১৮৪১৬)


রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন: ‘দু‘আ হলো ইবাদতের মূল।’ (সুনানে তিরমিযী হা.নং ৩৩৭১) 


নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেন: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার নিকট দু‘আ করে না আল্লাহ তা‘আলা তার উপর নারাজ হন ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ:হা. নং ৩৮২৭ , তিরমিযী হা.নং ৩৩৭৩)

 

উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে বুঝা গেল যে, সকলের জন্য দু‘আ করা অপরিহার্য । চাই উহা ফরয নামাযের পরে হোক বা অন্য সময় হোক । যারা দু‘আ করবে না তারা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধের পাত্র হবে।


নামাযের পর বা ফরয নামাযের পর কোন প্রকার বাড়াবাড়ি ব্যতিরেকে আমাদের দেশে যে মুনাজাত চালু আছে তা মুস্তাহাব আমল, বিদ‘আত নয় । কারণ, বিদআত বলা হয় ঐ আমলকে, শরী‘আতে যার কোন ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না । অথচ উক্ত মুনাজাত বহু নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়েত দ্বারা সু-প্রমাণিত।


সম্মিলিত মুনাজাত দুইভাবে হতে পারে । এক. সমবেত লোকদের মধ্যে একজন দু‘আ করবে এবং অন্যরা আমীন বলবে। দুই. একস্থানে সমবেত হয়ে সবাই নিজস্বভাবে দু‘আ করবে । এই উভয় সূরত জায়িয । এ ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর আমল ও নির্দেশ বিদ্যমান । তাই যারা মুনাজাতকে একেবারেই অস্বীকার করে তারা ভুলের মধ্যে আছে । যারা ইমাম-মুক্তাদির সম্মিলিত মুনাজাতকে বিদ‘আত বলে তাদের দাবিও ভিত্তিহীন। আবার যারা মুনাজাতকে জরুরি মনে করে বাড়াবাড়ি করে অর্থাৎ কেউ না করলে তাকে কটাক্ষ করে গালি দেয় তারাও ভুলের মধ্যে আছে ।


হাদীসে সম্মিলিত মুনাজাতের গুরুত্বের বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। ফিকহের কিতাবসমূহেও ইমাম-মুক্তাদির সম্মিলিত মুনাজাতকে মুস্তাহাব বলা হয়েছে। অসংখ্য হাদীস বিশারদগণের রায়ও সম্মিলিত মুনাজাতের স্বপথে স্পষ্ট বিদ্যমান। এমতাবস্থায় প্রচলিত সম্মিলিত মুনাজাতকে বিদ‘আত বলা হঠকারিতা ছাড়া কিছুই নয়। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন: ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাত এর শরয়ী বিধান-মুফতী মনসূরুল হক দা.বা.)


নিম্নে মুনাজাত স্বপক্ষে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হলোঃ


১. হযরত হাবীব ইবনে মাসলামা রা. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেছেন: ‘যদি কোন দল একত্রিত হয়ে তাদের একজন দু‘আ করে থাকে আর অপররা ‘আমীন, আমীন’ বলে থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের দু‘আ অবশ্যই কবুল করেন।’ (মুস্তাদরাক হাকেম: ৫৪৭৮)


২. হযরত সালমান রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ইরশাদ করেছেন: ‘যদি কোন জামা‘আত কোন বিষয় প্রার্থনা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার দরবারে হাত তুলে আল্লাহ তা‘আলার উপর ওয়াজিব হয়ে যায় যে, তিনি তাদের প্রার্থিত বস্তু তাদের হাতে দিয়ে দিবেন ।’ (সুনানে আবূ দাউদ: হা. নং ১৪৮৮)


৩. ইতিহাসে হযরত আলা আল-হাযরামী রা. এর ঘটনা সুপ্রসিদ্ধ। বাহরাইনের মুরতাদদের বিরুদ্ধে ১১ হিজরীতে যে লড়াই হয়েছিল তাতে তিনি সিপাহসালার ছিলেন। এই ঘটনার মধ্যে আছে যে, মুসলিম বাহিনী একস্থানে যাত্রা বিরতি করলে কাফেলার সকল উট রসদপত্রসহ পলায়ন করলো । ঘটনার শেষে আছে যে যখন ফজরের আযান হলো। তখন হযরত আলা আল-হাযরামী রা.নামাযের ইমামতি করলেন । নামাযের পর দুজানু হয়ে বসে অত্যন্ত বিনয় ও কাতরতার সঙ্গে দু‘আয় মশগুল হয়ে গেলেন । কাফেলার সকলেই তার সাথে সম্মিলিতভাবে দু‘আ করতে লাগলেন । এ অবস্থায় সূর্য উদিত হলো তবুও তারা দু‘আয় মশগুল রইলেন । এক পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদের সন্নিকটে একটি বড় জলাশয় সৃষ্টি করে দিলেন । সবাই সেখানে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করলেন এবং গোসল করলেন । বেলা কিছু চড়ার পর একে একে সকল উট সমস্ত রসদপত্রসহ ফিরে আসতে লাগলো । আরবী মূল পাঠ নিম্নরূপ: (আল-বিদায়া ওয়ান নেহায়াঃ৬/৩২৪)


 فلما قضي الصلوة جثي علي ركبتيه وجثا الناس و نصب في الدعاء و رفع يديه وفعل الناس مثله 

فلما قضي صلوته جثي  لركبتيه وجثا الناس فنصب في الدعاء ونصبوا معه  -مكتبة دار الكتب العلمية


(তারীখে তাবারী ২য় খণ্ড ২৮৭ পৃষ্ঠায়) 

                           

৪. আসওয়াদ আমেরী তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে ফজরের নামায আদায় করলাম, যখন তিনি সালাম ফিরিয়ে ঘুরে বসলেন তখন উভয় হাত উঠিয়ে দু‘আ করলেন । (ইলাউস সুনান হা.নং ৯৩৭ )


৫. হযরত আবূ উমামা বাহেলী রা. বর্ণনা করেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে, কোন দু‘আ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি? ইরশাদ হলো, শেষ রাত্রে (তাহাজ্জুদের পর ) এবং ফরয নামাযের পর । (সুনানে তিরমিযী হা.নং ৩৪৯৯)


৬. ইয়া‘লা বিন শাদ্দাদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা আমার নিকট বর্ণনা করেছেন যে, একবার আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট ছিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের মাঝে কি কোন অপরিচিত ব্যক্তি আছে, অর্থাৎ আহলে কিতাব? আমরা বললাম, না ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি দরজা বন্ধ করার আদেশ দিলেন এবং বললেন, ‘তোমরা সকলেই হাত উত্তোলন করো এবং বলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু!’ আমরা সকলেই এক সাথে হাত উত্তোলন করলাম। অতঃপর তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এই কালেমা দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং এর উপর জান্নাতের ওয়াদা করেছেন আর আপনি ওয়াদা খেলাফ করেন না। অতঃপর তিনি বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো ,তোমাদের মাফ করে দেয়া হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদঃ হা.নং১৭১২৬)


উল্লেখিত হাদীসসমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, একজন দু‘আ করবে আর অন্যরা সবাই আমীন বলবে, এভাবে সকলের দু‘আ বা সম্মিলিত মুনাজাতের কবুল হওয়া অবশ্যম্ভাবী।


হযরত আলা আল-হাযরামী রা. তার জামা‘আতের সকলকে নিয়ে ফজরের নামাযের পর যে  সম্মিলিত মুনাজাত করেছেন, সাহাবাগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যদি এমনটি করতে না দেখতেন তাহলে তারা কখনো এমনটি করতেন না।


ফরয নামাযের পর দু‘আ কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশীঃ


রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযের পর হাত উঠিয়ে দু‘আ করলেন। আর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দু‘আ সর্বদা কবুল হতো । তাই হুযুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  নামাযের পর হাত উঠিয়ে দু‘আ করবেন আর সাহাবাগণ তার বিরুদ্ধাচরণ করনার্থে হাত না উঠিয়ে বসে থাকবেন এটা কল্পনাই করা যায় না ।


বিধায় উল্লেখিত হাদীসসমূহ দ্বারা ফরয নামাযের পরে ইমাম মুক্তাদি সকলের জন্য সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল । অতএব, সম্মিলিত মুনাজাত মুস্তাহাব হওয়াই হাদীসসমূহের মর্ম ও সমষ্টিগত সারকথা।


যারা ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতকে বিদ‘আত বলে থাকেন তারা বলেন, হাদীসের মাঝে ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতের কথা পাওয়া যায় না, কিছু হাদীসে শুধু দু‘আর কথা পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে হাত তোলার কথা নেই। আবার কোন জায়গায় হাত তোলার কথা আছে, কিন্তু একাকিভাবে সম্মিলিতভাবে নয় । আবার কোনটিতে সম্মিলিত হওয়ার কথা আছে, কিন্তু ফরয নামাযের পরে  হওয়ার কথা উল্লেখ নেই। অতএব, এ সকল হাদীস দ্বারা ফরয নামাযের পরে সম্মিলিত মুনাজাত প্রমাণিত হয় না ।


তাদের কথা ঠিক নয়। কারণ, আমরা ইতিপূর্বে আলা আল-হাযরামী রা. এর সকল সাথীকে নিয়ে ফজরের ফরয নামাযের পরে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার কথা উল্লেখ করেছি। 


তাদের অভিযোগের ভিত্তিই সহীহ নয়। কারণ শরী‘আতে এমন কোন বিধান নেই যে, প্রত্যেক ইবাদতের সকল অংশ কোন একটি আয়াত বা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। এটা তেমনি যেমন নামাযের বিস্তারিত নিয়ম, আযানের সুন্নাত তরীকা, উযূর সুন্নাত তরিকা ইত্যাদি একত্রে কোন হাদীসে বর্ণিত নেই। বিভিন্ন হাদীসের সমষ্টিতে তা ছাবিত হয়, তারপরেও তা সকল উলামায়ে কেরামের নিকট গ্রহণযোগ্য ।


যারা ফরয নামাযের পরে সর্বাবস্থায় ইজতেমায়ী মুনাজাতের বিরোধী এবং সালাম ফিরানোর সাথে সাথেই উঠে পড়েন, তাদের এ কর্ম-কাণ্ড দ্বারা নামাযের পর যে মাসনূন ও জিকির দু‘আ ইত্যাদি রয়েছে তা তরক করা হয় এবং ফরয ও সুন্নাতের মাঝখানে কিছু সময়ের ব্যবধান করার যে হুকুম হাদীস শরীফে এসেছে তাও লঙ্ঘন করা হয় ।


তাদের জন্য নিম্নের হাদীসটি বিশেষভাবে প্রণিধান যোগ্য, আবু মিরছা রা. বর্ণনা করেন, একবার আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর সাথে নামায পড়ছিলাম। হযরত আবু বকর ও উমর রা. ঐ নামাযে উপস্থিত ছিলেন। তারা  প্রথম কাতারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  এর সাথে দাঁড়াতেন। আমাদের সাথে এক ব্যক্তি ছিল, যে উক্ত নামাযে তাকবীরে উলা থেকেই উপস্থিত ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  নামায শেষ করে সালাম ফিরালেন এমনভাবে যে, উভয়দিকে আমরা তার গণ্ডদয় দেখতে পেলাম । অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ঘুরে বসলেন। তখন ঐ তাকবীরে উলায় উপস্থিত ব্যক্তি সুন্নাত নামায পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লো। তৎক্ষণাৎ হযরত উমর রা. লাফিয়ে উঠলেন এবং ঐ ব্যক্তির কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, বসে পরো, পূর্ববর্তী কিতাবধারীদের ধর্মীয় পতন হয়েছে যখন তারা (ফরয ও সুন্নাত ) নামাযের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করতো না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  হযরত উমর রা. এর কাজ দেখে দৃষ্টি উঠালেন এবং বললেন, ‘হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহ তোমাকে সঠিক পন্থী বানিয়েছেন।’ (সুনানে আবূ দাঊদ হা.নং ১০০৭)


এ সকল বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, নামাযের পর ইমাম মুক্তাদি সকলের জন্য ওয়াজিব মনে না করে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা মুস্তাহাব ।


উল্লেখ্য, কোন আমল  মুস্তাহাব প্রমাণের জন্য নবীজীর আমল বিদ্যমান থাকা জরুরী নয় বরং মৌখিক হাদীস দ্বারাও মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। যেমন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  থেকে আযান দেয়া ইশরাক, চাশতের নামায পড়া তাহিয়্যাতুল উযূ ও তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়া প্রমাণিত নাই। তারপরেও মৌখিক হাদীস বিদ্যমান থাকায় উলামায়ে কেরাম  এ আমলগুলোকে মুস্তাহাব বলেছেন । (ফয়যুল বারী  ২/৩৫১)


আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সঠিক বিধান বুঝার এবং সুন্নাত মুতাবিক সহীহ আমল করার তাওফীক দান করুন । আমীন ।

Wednesday, March 29, 2023

নামাযের ওয়াক্ত

 নামাযের ওয়াক্ত


আল্লাহ তা‘আলা নামাযকে সময়ের সাথে খাস করে দিয়েছেন। প্রত্যেক নামাযের নির্ধারিত সময় রয়েছে। প্রত্যেক নামাযকে তার নির্ধারিত সময়ে আদায় করা ফরয। গ্রহণযোগ্য কোনো ওযর ছাড়া এক নামায অন্য নামাযের সময়ে আদায় করলে কবীরা গুনাহ হবে। সবাই যেন নামাযের সঠিক সময় জেনে সময় মতো নামায আদায় করতে পারে সেজন্যই আমাদের এই প্রয়াস।


হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মে‘রাজ থেকে এসে নামাযের প্রাকটিক্যাল ট্রেনিং, নামাজের ওয়াক্ত এসব কিছু সাহাবাদের রা. যুহরের সময় জানালেন। ফজরের সময় যেহেতু সকলকে একত্র করা কঠিন ছিল, তাই এসব কিছু যুহর থেকে শুরু করলেন। এজন্য হাদীসের কিতাবেও নামাযের ওয়াক্তের বর্ণনা যুহর থেকে শুরু করা হয়েছে।


যুহরের ওয়াক্ত: দ্বিপ্রহর থেকে সূর্য যখন একটু পশ্চিম দিকে হেলে যায় তখন যুহরের ওয়াক্ত শুরু হয়। এবং প্রতিটা জিনিসের আসল ছায়া ব্যতীত তার ছায়া দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত যুহরের ওয়াক্ত থাকে। জুম‘আ আর যুহরের নামাযের ওয়াক্ত এক ও অভিন্ন। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৩)


বি.দ্র.: ঠিক দুপুরে প্রত্যেক জিনিসের ছায়া যে পরিমাণ থাকে তাকে ঐ জিনিসের আসল ছায়া বলা হয়। কোনো ইমামের মতে আসল ছায়া ছাড়া প্রত্যেক জিনিসের ছায়া যখন একগুণ হয়ে যায় তখনই যুহরের সময় হয়ে যায়। আমাদের হানাফী মাযহাবের ফাতাওয়া এমন না। তাই একান্ত অপারগতা ছাড়া এই মতের উপর আমল করা যাবে না।


যুহর ও জুম‘আর নামাযের উত্তম সময়ঃ 

শীত কালে যত তাড়াতাড়ি যুহরের নামায পড়া যায় তত ভাল। গরমের দিন এক মিছিলের শেষ চতুর্থাংশে পড়া ভাল। তবে জুম‘আর নামায সব মৌসুমে আউয়াল ওয়াক্তে পড়া উত্তম। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৯)


জুম‘আর নামাযের উত্তম সময়ঃ 

যখন যুহরের সময় হবে তখন সাথে সাথে আযান হবে এবং তখনই মসজিদে রওনা করা জরুরী হয়ে যাবে। তিনটি জিনিস এক সাথে হবে: ১. ওয়াক্ত হওয়া ২. আযান হওয়া ৩. মসজিদে রওনা হওয়া। তারপর ১৫/২০ মিনিট  বা সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা বয়ান হবে। বয়ান চলাকালীন যাদের উযূ প্রয়োজন তারা উযূ করে নিবে। বয়ান শেষে জুম‘আর দ্বিতীয় আযান হবে। আযান শেষ হলে খুতবা তারপর ফরয নামায হবে। সাধারণত শীতকালে দিন ছোট হওয়ার কারণে একটু আগে ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। সর্বোচ্চ দুপুর সোয়া একটা থেকে দেড়টার মধ্যে পুরো নামায শেষ হয়ে যাবে। যেহেতু জুম‘আর আগে বয়ানের জন্য দীর্ঘ সময় পাওয়া যায় না তাই নামায শেষে পুনরায় দীনী বয়ান বা মাসআলা মাসায়েলের আলোচনা হতে পারে।


জুম‘আর নামাযঃ

জুম‘আর নামায মোট বার রাকা‘আত। কাবলাল জুম‘আ চার রাকা‘আত, ফরয দুই রাকা‘আত, বা‘দাল জুম‘আ চার রাকআত, ওয়াক্তিয়া সুন্নাত দুই রাকা‘আত। কোনো কোনো বড় গ্রামে এখনও আখেরী যুহর বা এহতিয়াতি যুহর পড়ে, এগুলি জায়েয নেই। বাংলাদেশের বড় গ্রামগুলো শহরের হুকুমে। সেখানে আখেরী যুহর পড়লে গুনাহ হবে। হ্যাঁ, এখনো যদি কোনো অজপাড়া থাকে যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিস পাওয়া যায় না, রাস্তা ঘাট নেই, দোকান পাট নেই, কম সংখ্যক লোক ব্যবসা করে তাহলে তারা জুম‘আ ও ঈদ পড়বে না। সেখানে ভুলক্রমে জুম‘আ পড়ে ফেললে চার রাকা‘আত ইহতিয়াতি যুহর পড়ে নিবে।


আসরের নামাজের ওয়াক্তঃ

যুহরের নামাযের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথে আসরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। এর মাঝখানে কোনো বিরতী নেই। সূর্য অস্থ যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আসরের ওয়াক্ত থাকে। তবে সূর্য ডুবার ১৫ মিনিট আগ পর্যন্ত উত্তম সময়। । (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৫)


আসরের মাকরূহ ওয়াক্তঃ

সূর্য অস্থ যাওয়ার ১৫ মি. আগ থেকে মাকরূহ সময় শুরু হয়ে যায়। এই সময় নামায পড়লে নামায আদায় হয়ে যাবে কিন্তু মাকরূহ হবে। ইচ্ছা করে এই সময়ে নামায পড়লে গুনাহ হবে। আর যদি এমন হয় যে, কেউ ঐ দিনের আসরের নামায আদায় করেনি ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে যাচ্ছে তাহলে তাকে ঐ সময়ই আসর পড়তে হবে। কিন্তু এটা মাকরূহে তাহরীমা হবে। তবে ফরজের যিম্মাদারি আদায় হয়ে যাবে। । (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩৫)


আসরের উত্তম সময়ঃ 

আসর সবসময় দেরি করে পড়া ভালো। কেননা আসরের পরে কোনো নফল পড়া যায় না। সুতরাং আসরের সময় হওয়ার প্রায় আধাঘণ্টা বা পোনে এক ঘণ্টা পরে আসর পড়বে। যাতে আসরের আগে বেশি করে নফল পড়া যায়। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৯)


মাগরিবের ওয়াক্তঃ

বেলা সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে মাগরিবের নামাযের ওয়াক্ত এবং ইফতারের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। (ইফতার দেরি করে করা মাকরূহ) মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার সাথে সাথে আযান ইকামাত দিয়ে নামায আদায় করা উত্তম। পশ্চিম আকাশ বেশ কিছু সময় লালিমা থাকে, এই লালিমা শেষ হওয়ার পর একটু সাদা ভাব হয়। সাদা ভাব শেষ হওয়ার পর আকাশ কালো হতে শুরু করে। আকাশ কালো হওয়ার আগ পর্যন্ত মাগরিবের ওয়াক্ত থাকে। অর্থাৎ আকাশের অবস্থা যতক্ষণ লাল ও সাদা মিশ্রিত থাকে ততক্ষণ মাগরিবের ওয়াক্ত থাকে। মাগরিবের সময় প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। আমাদের দেশের অনেকে মনে করে মাগরিবের সময় ১৫-২০ মি. থাকে। যার কারণে এই সময়ের ভিতর মাগরিব পড়তে না পারলে আর পড়ে না। মনে করে কাযা যখন হয়ে গেল তখন পরে এক সময় পড়ে নিব। অথচ সোয়া এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে নামায পড়লেও আদায় হয়ে যাবে। কোনো ইমামের মতে লাল শেষ হয়ে সাদা শুরু হওয়ার সাথে সাথে মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়ে ইশার ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। আমাদের হানাফী মাযহাবে এ মতের উপর ফাতাওয়া নয়। তাই একান্ত ঠেকা ছাড়া ঐ সময়ে ইশা পড়বে না। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৫-২৬)


মাগরিবের উত্তম সময়ঃ 

মাগরিব নামায ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে পড়া উত্তম। কিন্তু রমযান মাসে একটু দেরি করে পড়তে বলা হয়েছে। যাতে আগে ইফতার করে নেয়া যায়। কারণ আগে ইফতার করতে পারলে নামায খুশু-খুযুর সাথে হবে। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩১)


ইশার নামাযের ওয়াক্তঃ

মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইশার ওয়াক্ত শুরু হয়ে যায়। ইশার ওয়াক্ত ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে। তথা সাহরীর ওয়াক্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত থাকে। (আল বাহরুর রায়েক ১)


ইশার উত্তম সময়ঃ

রাতের এক তৃতীয়াংশের শেষের দিকে ইশা পড়া উত্তম। অর্থাৎ ইশার সময় হওয়ার সোয়া এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে ইশা পড়া উত্তম। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩০)


ইশার মাকরূহ সময়ঃ 

বিশেষ কোনো ওযর ছাড়া মধ্য রাতের পরে ইশা পড়া মাকরূহ। রুগীর সেবা ওযরের মধ্যে গণ্য হতে পারে কিন্তু ওয়ায মাহফিল ওযরের মধ্যে গণ্য হবে না। তাই ওয়ায মাহফিলেও যথা সময়ে ইশার নামায আদায় করা জরুরী। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩১)


ফজরের ওয়াক্তঃ

সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত ফজরের ওয়াক্ত থাকে। পূব আকাশের উত্তর-দক্ষিণে যখন সাদা একটা আলো ছড়ায় তখন ফজরের ওয়াক্ত হয়। সূর্যের কিনারা দেখা পর্যন্ত ফজরের ওয়াক্ত থাকে। ফজরের সময়ের মধ্যেও মাগরিবের মতো আকাশ সাদা ও লাল হয়। ফজরে প্রথমে আকাশ সাদা হয় তারপর লাল হয় আর মাগরিবে প্রথমে লাল হয় এরপর সাদা হয়। ফজরের সময়ও প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৩)


ফজরের উত্তম সময়ঃ 

ফজরের সময় আলো উত্তর-দক্ষিণে ছড়িয়ে যাওয়ার পরে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম  ফজর পড়তে বলেছেন। এ সময় ফজর পড়া উত্তম এবং বেশি সাওয়াব লাভের কারণ। কিন্তু রমযান মাসে আউয়াল ওয়াক্তে ফজর পড়ার মধ্যে বেশি সাওয়াব। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪২৮-২৯)


ইশরাকঃ 

সূর্য উঠা শুরু হওয়া থেকে নিয়ে ১৫-২০মি. পর এই নামাযের সময় শুরু হয় এবং দ্বিপ্রহর পর্যন্ত এর সময় থাকে। সময় হওয়ার পর পর ইশরাক পড়া ভাল। এই নামায নফল। দুই চার রাকা‘আত যা পারা যায় পড়া। এই নামায যে পড়ে, সারা দিনের সমস্ত প্রয়োজনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। (আততারগীব ওয়াত তারহীব হা.নং ১০০৯)


চাশতঃ 

ইশরাক এবং চাশতের নামাযের সময় এক। তবে বেলা এগারটার দিকে চাশতের নামায পড়া ভাল। চাশতের নামায সর্বোচ্চ বার রাকা‘আত। এই নামাযও নফল। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২৪)


যাওয়ালঃ 

যখন যুহরের ওয়াক্ত শুরু হয় তখন সাথে সাথে যাওয়ালের ওয়াক্ত শুরু হয়। যাওয়ালের নামায ২-৪ রাকা‘আত। এই নামাযকে দিনের বেলার তাহাজ্জুদ বলা হয়। এর নেকীও তাহাজ্জুদ নামাযের মতো এবং হাদীসে এসেছে, এই সময়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আসমানে সব দরজা খুলে দেন। (আততারগীব ওয়াত তারহীব হা.নং ৮৫৭,৮৫৯,৮৬২)


আউয়াবীনঃ 

মাগরিবের ফরযের পর এই নামায। মাগরিবের দুই রাকা‘আত সুন্নাত ছাড়া ছয় রাকা‘আত পড়তে পারলে উত্তম। তবে মাগরিবের দুই রাকা‘আত সুন্নাতসহ পড়লেও হবে। (গুনইয়াতুল মুতামালি পৃ.৪৩০)


তাহাজ্জুদঃ 

এই নামায রাতে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়। উত্তম হলো শেষ রাতে পড়া। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন পূর্ণ সুস্থ ছিলেন তখন আট রাকা‘আত পড়তেন। যখন একটু বয়স বাড়লো তখন ছয় রাকা‘আত পড়তেন। যখন আরো বয়স বাড়লো, শরীর ভারী হয়ে গেল তখন চার রাকা‘আত পড়তেন। এই নামায ৪-৮ রাকা‘আত পড়তে হয়। এই নামায পড়ার জন্য ইশার নামায পড়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলে ভালো হয়। তবে বিশেষ কারণে কেউ যদি এই নামায উত্তম সময়ে পড়তে না পারে তাহলে সে যদি ইশার সুন্নাতের পর বিতিরের আগে দুই চার রাকা‘আত তাহাজ্জুদের নিয়তে পড়ে নেয় তাহলে আশা করা যায় এতেও আল্লাহ তা‘আলা তাকে তাহাজ্জুদের নেকী দান করবেন। (গুনইয়াতুল মুতামালি পৃ. ৪৩২)


নামাযের মাকরূহ ওয়াক্ত: তিনটি সময় আছে যখন যেকোনো ধরণের নামায, জানাযার নামায ও সিজদায়ে তিলাওয়াত নিষেধ: 


১. সূর্য উঠার সময়।


২. সূর্য যখন মাথার ঠিক উপরে থাকে তখন। (ক্যালেন্ডারে দ্বিপ্রহর বলে এই সময়কে বুঝানো হয়)


৩. সূর্য অস্থ যাওয়ার সময়। তবে ঐদিনের আসর না পড়ে থাকলে এই মাকরূহ ওয়াক্তে পড়া যাবে। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩২-৩৩)


তিনটি সময় এমন আছে যখন নফল নামায পড়া মাকরূহ। তবে ঐ সময়ে কেউ উমরী কাযা পড়তে চাইলে পড়তে পারবে।


১. ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পর ফজরের সুন্নাত ছাড়া অন্য কোনো সুন্নাত বা নফল পড়া যায় না। এমনিভাবে ফজরের ফরয নামায পড়ার পর থেকে নিয়ে সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত কোনো নফল নামায পড়া যায় না।


২. সূর্য্য যখন উঠতে শুরু করে তখন থেকে ১৫ মি. পর্যন্ত নফল নামায পড়া যায় না।


৩. আসরের নামায পড়ার পর থেকে সূর্য অস্থ যাওয়া পর্যন্ত কোনো নফল পড়া যায় না। (আল বাহরুর রায়েক ১/৪৩৭)


Monday, March 27, 2023

কওমী মাদরাসার ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদান

 কওমী মাদরাসার ইতিহাস ঐতিহ্য ও অবদান


বিশ্বের শীর্ষ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দের সম্মানিত মুহতামিম


হযরত মাওলানা আবুল কাসেম নুমানি সাহেব দা. বা.এর ঐতিহাসিক বয়ান


(স্থান: ফ্রেন্ডস্ ক্লাব মাঠ, সেক্টর-৩, উত্তরা, ঢাকা। তারিখ: ৯ই ফেব্রুয়ারী, শনিবার, ২০১৩ ঈ.)


ভাষান্তর: শাইখুল হাদীস মুফতী মনসূরুল হক দা. বা.


اليوم أكملت لكم دينكم وأتممت عليكم نعمتى ورضيت لكم الإسلام دينا.  قال الله تبارك و تعالى


সম্মানিত উলামায়ে কেরাম,বুযুর্গানে দ্বীন, যুবক বন্ধুগণ, ও প্রিয় অনুজ! 


আজকের এই জৌলুসপূর্ণ মাহফিল শহর অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এখানে অংশগ্রহণকারীগণের মধ্যে রয়েছেন নিজ নিজ অঞ্চলের উচ্চ পর্যায়ের উলামায়ে কেরাম, বড় বড় দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের মুহতামিমগণ, শাইখুল হাদীস, শিক্ষকবৃন্দ,শহরের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ ও প্রিয় শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ, এ দিকে লক্ষ্য করে এটি একটি মহিমান্বিত মাহফিল। 


সময় স্বল্পতার কারণে সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ কিছু আলোচনা করবো, যা আমরা আমাদের আমলী জীবনে পাথেয়রূপে গ্রহণ করতে পারি এবং তার আলোকে আলোকিত হতে পারি।

 

আমার প্রিয় বন্ধুগণ!

ঘোষণার মধ্যে আমার ব্যাপারে বারংবার একটি নিসবত ও সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছিল, আর তা হচ্ছে ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ এর নিসবত, যা আমাদের আকাবিরের আমানত, যার খেদমতের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার তাওফীক আমার হয়েছে। এই নিসবতকে কেন্দ্র করেই আমাদের প্রতি গণমানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মুহব্বাত, তার কারণ হলোঃ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আকাবিরকে আক্বীদা, ইলম, আমল, পরহেযগারী, খোদাভীতি, দ্বীনদারী, বীরত্ব, আমানতদারী, প্রভৃতি যাবতীয় বৈশিষ্ট্যে এমনভাবে বৈশিষ্ট্যময় করেছিলেন যে, সেগুলোর যে কোন একটি নিয়ে চিন্তা করলে এবং তাদের জীবনের যে কোন অধ্যায়ের প্রতি লক্ষ্য করলে দেহে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়, জীবনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।


দেওবন্দ পৃথক কোনো দল বা গোষ্ঠীর নাম নয়, বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২৩ বৎসরের জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরাম রাযি.কে যে শিক্ষার ধারক বাহক বানিয়ে ছিলেন, আক্বীদার সংশোধন করেছিলেন, সৎচরিত্রের মূর্তপ্রতিক বানিয়েছিলেন, ন্যায়-নিষ্ঠা, তাক্বওয়া, আমানতদারী, দ্বীনদারী, খোদাভীতি, সুন্নাতের অনুকরণ, খোদাপ্রেম, রাসূলপ্রেম, আল্লাহর রাহে সর্বস্ব বিলীন করে দেওয়ার অদম্য উদ্দীপনা, একনিষ্ঠ একত্ববাদ, দ্বীনের ক্ষেত্রে অটলতা ও দৃঢ়তা, বাতিল আক্বীদা-বিশ্বাস ও বাতিল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন মনোভাব প্রভৃতি সমুদয় বৈশিষ্ট্যাবলী যা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে স্বরূপে বিদ্যমান ছিল এবং বংশ পরম্পরায় ক্রমান্বয়ে এক জামা‘আত থেকে আরেক জামা‘আতে, এক স্তর থেকে আরেক স্তরে ধারাবাহিকভাবে স্থানান্তরিত হয়ে বক্ষ্যমাণ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত পৌঁছে, আল্লাহ তা‘আলা সেগুলোর বাস্তব নমুনা ও মৌলিক শিক্ষা আকাবিরে দেওবন্দকে দান করেছেন, তারা একদিকে ঈমান-আক্বীদাগতভাবে ছিলেন দুর্নিবার ও সুদৃঢ়, কবর পূজা প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিলেন আপোষহীন, সুন্নাতের অনুকরণে এতটাই যত্নবান ও সতর্ক ছিলেন যে, সামান্য থেকে সামান্য আমলও সুন্নাত পরিপন্থী হতো না, চাই তা সুন্নাতে মুআক্কাদা না হয়ে সুন্নাতে আদিয়া হোক ও তাদের সুনানে ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত না হোক।


প্রথম পর্যায়েঃ 

আমি আপনাদের সম্মুখে সাহাবায়ে কেরামের কিছু ঘটনা বর্ণনা করবো, সাথে সাথে আকাবিরে দেওবন্দের কিছু ঘটনাও উপস্থাপন করবো। অতঃপর আমি আহবান করবো আপনাদেরকে এই সমস্ত ঘটনার পারস্পরিক গভীর সম্পর্ক অমিল লক্ষ্য করার জন্য, আমার এই আহবান বাস্তবতার প্রকাশ হিসেবে, কবি বলেনঃ


 اولئك أبائ فجئنى بمثلهم-إذا جمعتنا يا جريرالمجامع. 


অর্থাৎঃ [স্বীয় পূর্বপুরুষের গুণাবলি বর্ণনা করার পর] তারাই আমার পিতৃপুরুষ, জনসমাগম ঘটলে সম্ভব হলে তাদের কোন সমকক্ষ নিয়ে এসো!


বাপ-দাদাদের কৃতিত্ব ও বড়ত্ব বর্ণনা করে নিজের বুক ফুলানোর মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। বরং এর দ্বারা এই শিক্ষা গ্রহণই উদ্দেশ্য যে, তারা কী কী গুণাবলি দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিলেন এবং সে তুলনায় আমাদের মাঝে কী কী ত্রুটি, দুর্বলতা, ব্যর্থতা ও অসম্পূর্ণতা রয়েছে, সেগুলো যাচাই করে তাদেরকে আয়না বানিয়ে নিজেদের জীবনের ইসলাহ্ ও সংশোধন করা। 


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সাহাবাদের মহব্বত ছিল ইশক এর স্তরের। তাদের ক্ষুদ্রতম কোনো আমলও সুন্নাত পরিপন্থী হবে এটা তাদের কাছে অসহনীয় ছিল। তাদের কারও কলিজার টুকরা সন্তানও যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত পরিপন্থী কোনো কাজ করতো অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কোনো নির্দেশ পালনের ব্যাপারে সামান্য গড়িমসি করতো, তাহলে তার সাথে আজীবন কথাবার্তা পর্যন্ত পরিত্যাগ করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এক একটি সুন্নাত তাদের নিকট এতটাই প্রিয় ছিল যে, সেটার বিপরীতে অন্য সব কিছু একেবারেই নগণ্য ও তুচ্ছ।


# হযরত ইবনে মাসউদ রাযি. যিনি প্রথম সারির বিশিষ্ট সাহাবিদের অন্যতম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেনঃ


 رضيت لأمتى ما رضى لها ابن أم عبد. 


অর্থাৎঃ আমার উম্মতের যে ব্যাপার নিয়ে ইবনে মাসউদ সন্তুষ্ট, আমিও তাতে সন্তুষ্ট, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তৎকালীন সমগ্র সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, اتخذوا القرأن من أربعة... অর্থাৎঃ তোমরা চারজনের নিকট থেকে কুরআন শিক্ষা করো...(মুসলিম হা. নং ২৪৬৪) তাদের মধ্যে ইবনে মাসউদ রাযি. এর নামও উল্লেখ করেছেন। 


তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এতটা উন্নত ছিল যে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহধাম ত্যাগ করেছিলেন, সেই সাহাবাগণ তখনও জীবিত যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সমুন্নত জীবন চরিত স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, দেখেছিলেন তার আমল, উঠাবসা, চাল-চলন; তাকে স্থান দিয়েছিলেন স্বীয় মনের মনি কোঠায় ও তাকে আপন করে নিয়েছিলেন, কিন্তু যাদের এই সৌভাগ্য লাভ হয়নি তাদেরও এই আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন যাপন সম্পর্কে অবহিত হবেন, সুন্নাতকে শিখবেন, তদনুযায়ী জীবনকে সাজাবেন, যদি এর নমুনা জানা যায় তাহলে তো সৌভাগ্যের বিষয়, তাদের একজন জনৈক সাহাবীকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন যাপন পদ্ধতি সম্পর্কে বলুন! তার উঠা-বসা, চলা-ফেরা, কথা-বার্তা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি কিরূপ ছিল? তিনি উত্তরে বললেনঃ আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাযি.কে চিনো? সে বললোঃ জী। তিনি বললেনঃ তাহলে এক কাজ করো, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, যখন ইবনে মাসউদ স্বীয় ঘর থেকে বের হবেন তখন তুমি তার অনুসরণ করে তার প্রতিটি কাজ মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করবে যে, তিনি চলাফেরা, উঠা-বসা, কথা-বার্তা, নামায আদায়, মসজিদে প্রবেশ এবং বের হওয়াসহ যাবতীয় কাজকর্ম কীভাবে সম্পন্ন করেন, তুমি তাকে যেভাবে করতে দেখবে, হুবহু এটিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কর্মপদ্ধতি ছিলো। (বুখারী হা.নং ৩৭৬২)


দেখুন! এক সাহাবি অপর এক সাহাবির ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, এমনভাবে সুন্নাতের অনুসরণ করতেন যে, তিনি সুন্নাতের জীবন্ত নমুনা হয়ে গিয়েছিলেন।


একবার আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. জুম‘আর নামাযে উপস্থিত হলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবা দিচ্ছিলেন, কিছুলোক মসজিদে স্থান সংকুলানের অভাবে বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ ‘বসে পড়ো’! ইবনে মাসউদ রাযি. তখনও মসজিদে প্রবেশ করতে পারেননি, দরজার বাহির থেকে শুনলেন ‘বসে পড়ো’, তিনি সেখানেই বসে পড়লেন, তিনি এটা দেখতে গেলেন না যে, জায়গা পরিষ্কার কিনা, বরং তৎক্ষণাৎ বসে পড়লেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ডাক দিলেনঃ ইবনে মাসউদ! ভিতরে এসে বসো, তখন তিনি ভিতরে এসে বসলেন, প্রিয় বন্ধুগণ লক্ষ্য করুন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. এর কানে আওয়াজ  পৌঁছেছে ‘বসে পড়ো’, তো তিনি আর জিজ্ঞাসা করতে যাননি, এটা শুধু ইবনে মাসউদ রাযি. এর নয়, বরং সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম এর সার্বিক জীবন পদ্ধতি। 


# আরেকজন বিখ্যাত সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. এর ব্যাপারে তার পুত্র সালেম রহ.ও গোলাম নাফে’ রহ. এর সূত্রে বিস্তারিতভাবে রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে যে, যখন তিনি মদিনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ পানে রওয়ানা করতেন, তখন তিনি পূর্ণ গুরুত্বের সাথে এবিষয়টি অনুসরণ করতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন্ পথ দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন, কোন্ বৃক্ষের নিচ দিয়ে যাতায়াত করেছিলেন, কোন্ ঘাটিতে অবতরণ করেছিলেন, কোন্ পাহাড়ে আরোহণ করেছিলেন, কোথায় তাঁবু গেড়েছিলেন, কোথায় সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে নামায পড়েছিলেন, কোথায় রাত্রি যাপন করেছিলেন, প্রভাতে কোন্ পথে বের হয়েছিলেন, কোথায় ইস্তেঞ্জার জরুরত সেরেছিলেন, এভাবে খুঁজে খুঁজে প্রতিটি আমলের পুঙ্খানো পুঙ্খোরূপে অনুকরণ করতেন। মদীনা শরীফ থেকে মক্কা শরীফ পৌঁছা পর্যন্ত, সুন্নাত অনুসরণের ক্ষেত্রে এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বৃক্ষের ছায়ায় নামায আদায় করেছিলেন, তিনিও সেই বৃক্ষের ছায়ায় নামায আদায় করেছিলেন, তা দেখে তার অনুচরগণ তাঁকে অনুরোধ করে বললেন যে, হুযুর! মসজিদ থাকতে আপনি এখানে নামায পড়ছেন? তিনি উত্তরে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে নামায আদায় করেছিলেন, সুতরাং আমি এখানেই নামায আদায় করবো। 


একবার তিনি সফররত অবস্থায় একস্থানে বাহন থেকে অবতরণ করে একপাশে ইস্তেঞ্জা করার পদ্ধতিতে কিছুক্ষণ বসে পুনরায় সফর শুরু করলেন, সহচরবৃন্দ জিজ্ঞেস করলেনঃ হুজুর! বিষয়টি বুঝতে পারলাম না, আপনার ইস্তেঞ্জার জরুরত না থাকা সত্ত্বেও এভাবে বসার কারণ কী? তিনি বললেনঃ আরে বোকা! আমি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এক সফরে তার সফরসঙ্গী থাকাবস্থায় তিনি এই স্থানে বাহন থামিয়ে ইস্তেঞ্জার জরুরত সেরেছিলেন, আমি কীরূপে এই স্থান অতিক্রম করে চলে যাবো?


এক্ষেত্রে শরী‘আতের কোনো বাধ্য বাধকতা নেই, এগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্বাভাবিক কার্যক্রম ছিল যে, যেখানে নামাযের সময় হয়েছিল সেখানে নামায পড়ে নিয়েছিলেন, যেখানে রাত্র হয়েছিল সেখানে রাত্র যাপন করেছিলেন, যেখানে ইস্তেঞ্জার জরুরত হয়েছিল সেখানে সেটা সেরে নিয়েছিলেন, যে এর অনুসরণ করবে না বা এর বিরোধিতা করবে, সে সুন্নাত পরিত্যাগকারী বা বিরোধিতাকারী গণ্য হবে এমন কিছু নয়। কিন্তু ইশক ও মুহাব্বতের তাকাযা এটাই ছিলো যে, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিটি কার্যক্রমের হুবহু অনুকরণ করতেন, যত সামান্য ব্যাপারই হোক না কেন।


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের এ ধরনের রাসূলপ্রেমের ঘটনাবলি বর্ণনা করা শুরু হলে সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবে তবুও শেষ করা যাবে না। তাদের সমগ্র জীবনটাই ছিল রাসূলপ্রেমের অপূর্ব নমুনা।


এ পর্যায়ের আকাবিরে দেওবন্দের সুন্নাতের অনুসরণ ও রাসূলপ্রেমের কিছু নমুনা সংক্ষিপ্তরূপে আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করছি।


আকাবিরে দেওবন্দের মধ্য থেকে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য, তাদের অন্যতম হলেনঃ কাসেম নানুতবী রহ. ও রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ.। কাসেম নানুতবী রহ. এর সাধারণ জীবন-যাপন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, চাল-চলন ও সাধারণ অবস্থা দেখে কারও বোঝার উপায় ছিল না যে, ইনিই হলেন বিশ্বখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা, হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ.। তিনি সর্বাত্মকভাবে সুন্নাতের অনুকরণ করতেন এবং বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করার জন্য আত্মোৎসর্গ করে দিতে পর্যন্ত সদা প্রস্তুত ছিলেন। তার পুরো জীবনে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। 


আমি তাঁর সম্পর্কে দু’টি ঘটনা বর্ণনা করছিঃ 


প্রথম ঘটনা হলোঃ 

১৮৫৭ সালে এই ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য শামেলীর ময়দানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানগণ আমীরে শরীয়ত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. এর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, সেখানে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সম্মুখ সমরে বীর দর্পে লড়েছিলেন মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ., রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ., হাফেয যামেন শহীদ রহ., মাওলানা রহমতুল্লাহ্ কিরানবী রহ. সহ আরো বড় বড় উলামায়ে কেরাম। শামেলীর ময়দানে হাফেয যামেন শহীদ রহ. শাহাদাত বরণ করেন, কিন্তু ইংরেজদের চাটুকারিতায় মুসলমানদের পরাজয়ে রাজ্য সম্পূর্ণরূপে ইংরেজ বেনিয়াদের করতলগত হয়ে যায়।


সম্মুখসমরে নেতৃত্বদানকারীদের নামে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী হয়ে যায় এবং তারা ইংরেজদের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রদ্রোহী হওয়ার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির হুকুম হয়ে যায়। জেনে শুনে নিজের প্রাণকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া ও শত্রুর হাওয়ালা করে দেওয়া যেহেতু ইসলামের শিক্ষা নয়, বরং যথাসাধ্য আত্মরক্ষার পন্থা অবলম্বন করা উচিত, তাই কাসেম নানুতবী রহ. দেওবন্দ প্রত্যাবর্তন করে তিনদিন পর্যন্ত নিজ গৃহে আত্মগোপনে ছিলেন, তিনদিন পূর্ণ হওয়ার পর ঘর থেকে বের হয়ে ‘সাত্তা মসজিদে’ চলে এলেন যেখানে ডালিম বৃক্ষের নিচে দারুল উলুম দেওবন্দের গোড়াপত্তন হয়, খাদেমগণ তাকে অনুনয় বিনয় করে বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন যে, হযরত! ইংরেজরা আপনাকে পাগলা কুকুরের ন্যায় হন্য হয়ে খুঁজছে, আপনি এখনো বিপদমুক্ত নন, আপনার আরো কিছুদিন আত্মগোপনে থাকা উচিত, তখন তিনি উত্তরে যা বলেছিলেন সেটাই আমাদের জন্য লক্ষণীয় ও শিক্ষণীয়,  আর তা হলোঃ তিনি বললেন যে, কাসেম এর প্রাণ তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর রাযি. এর চেয়ে অধিক মূল্যবান নয়, কাসেম এর উপর আপতিত বিপদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর রাযি. এর উপর আপতিত বিপদের চেয়ে অধিক ভয়ানক নয়। হিজরতের পূর্ব মুহূর্তে যখন মক্কার কাফেররা  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শহীদ করে দেওয়ার চূড়ান্ত পাঁয়তারা করে ফেলেছিলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাযি.কে নিয়ে রজনীর অন্ধকারে বের হয়ে তিনদিন পর্যন্ত ছওর গুহায় আত্মগোপনে ছিলেন, চতুর্থ দিন সেখান থেকে বের হয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন, কাসেমের আত্মমর্যাদা এটা বরদাস্ত করতে পারে না যে, আমার মুনিব তিনদিন পর্যন্ত আত্মগোপনে ছিলেন, সেখানে আমি এর চেয়ে বেশী দিন আত্মগোপনে থাকবো।


চিন্তা করুন, কোথায় ছিল তাদের দৃষ্টি! প্রতি মুহূর্তে এই আশঙ্কা ছিল যে, শত্রুরা ধরে ফেলবে, যার পরিণতিতে নিশ্চিত ফাঁসি, কিন্তু দৃষ্টি ছিল সুন্নাতের উপর, আত্মগোপনেও সুন্নাতের অনুকরণ এবং বের হওয়াতেও সুন্নাতের অনুকরণ।


অনুরূপ আরেকটি ঘটনাঃ 

তখন হিন্দুস্তানে হিন্দুদের কুসংস্কারে প্রভাবিত হয়ে মুসলমানদের মধ্যেও বিধবা-বিবাহকে দোষনীয় ভাবা হতো, ফলে বিধবাদের বিবাহ হতো না। তাই কাসেম নানুতবী রহ. যথারীতি এর বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়ে উঠলেন, বিধবা বিবাহের পথে জোরালো প্রচারণা চালাতে লাগলেন এবং এ বিষয়টি জনসম্মুখে বয়ান করতে লাগলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পুণ্যাত্মা পত্নীগণের মধ্যে একমাত্র হযরত আয়েশা রাযি.ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে কুমারী অবস্থায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, অন্য সকল পত্নীগণের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন তালাকপ্রাপ্তা আর অধিকাংশই ছিলেন বিধবা, সুতরাং ‘বিধবা-বিবাহ’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত, এটাকে দোষনীয় মনে করা মারাত্মক অন্যায় ও ঈমানের জন্য হুমকি স্বরূপ। 


এরই ধারাবাহিকতায় তিনি একবার দিল্লীর জামে মসজিদে এ বিষয়ের উপর বয়ান করছিলেন, হঠাৎ এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললোঃ হুযুর! আমার একটি কথা আছে, তিনি যেহেতু আল্লাহর ওলী ছিলেন তাই তৎক্ষণাৎ ঘটনা আঁচ করতে পেরে বললেনঃ আপনি বসুন, অতঃপর উপস্থিত জনতাকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমাকে দশ মিনিট সময় দিন আমি একটি কাজ সেরে আসছি আপনারা বসুন, একথা বলে তিনি তার অন্দর মহলে প্রবেশ করে যেখানে তার এক বয়স্কা বিধবা বড় বোন ছিল, যার কাছে ইতিপূর্বে কোন পয়গাম আসেনি এবং তিনি প্রস্তাবও পাঠাননি, তিনি স্বীয় পাগড়ী তার পায়ের কাছে রেখে বললেনঃ আপা! আমি জানি, আপনার আর বিবাহের প্রয়োজন নেই, তবুও আপনি যদি পুনরায় বিবাহে সম্মত হয়ে যান, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনেক বড় একটি সুন্নাত পুনর্জীবন লাভ করবে। তখন তার বড় বোন বললেন যে, আমার দ্বারা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত প্রায় একটি সুন্নাত পুনর্জীবন লাভ করে তাহলে আমি এর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তিনি বের হয়ে তার এক বন্ধুর নিকট আসলেন যার স্ত্রী কিছুদিন পূর্বে মারা যায়, তাকে স্বীয় বড় বোনের সাথে তার বিবাহের প্রস্তাব দিলে সে বললো যে, এটাতো আমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়, আমি এতে রাজি। ঐ বন্ধু সানন্দে উক্ত প্রস্তাব লুফে নিলে তিনি ঘটনাস্থলেই দুই সাক্ষীর মাধ্যমে ঈজাব কবুল দ্বারা বিবাহ সম্পন্ন করে ফেললেন। তিনি দশ মিনিটের মধ্যেই এই পুরো কার্যক্রম সমাধা করে মসজিদে ফিরে আসলেন, অতঃপর জিজ্ঞেস করলেনঃ কে যেন কী বলতে চাচ্ছিলেন এবার বলুন, লোকটি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে বললো যে, ভালোই তো নিজের ঘরে বিধবা বড় বোন রেখে আমাদেরকে বিধবা বিবাহে উদ্বুদ্ধ করছেন, আগে তাকে বিবাহ দিয়ে আসুন, তিনি বললেনঃ আলহামদুলিল্লাহ! এই অসম্পূর্ণ কাজটি এইমাত্র সম্পন্ন করে এসেছি। তারপর ইশারা করলে সেই বন্ধু দাঁড়িয়ে বললোঃ আমিই তার বড় বোনকে বিবাহ করেছি, আমি তার ভগ্নীপতি। 


এভাবেই আমাদের আকাবিরের প্রত্যেকে সর্বদা এ উদ্দীপনা নিয়ে থাকতেন যে, আমার প্রিয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিপন্ন প্রায় প্রতিটি সুন্নাত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যেই ত্যাগ তিতিক্ষাই দরকার হোক না কেন তা দেয়ার জন্য আমি সদা সর্বদা প্রস্তুত।


প্রিয় বন্ধুগণ! আমাদের আকাবির এর এ ধরনের অনেক ঘটনাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো ভেবে পাচ্ছি না। 


এখন তাদের কিছু কিতাবের নাম উল্লেখ করছিঃ

(১) আরওয়াহে ছালাছা। (২) শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. রচিত ‘আপবীতী’। (৩) শাহ্ আব্দুল কাদের রায়পুরী রহ. এর জীবনী ‘সাওয়ানেহে মাওলানা আব্দুল কাদের’। (৪) মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. এর জীবন বৃত্তান্ত ‘সাওয়ানেহে কাসেমী’। (৫) মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. এর জীবন বৃত্তান্ত ‘তাযকিরাতুর রশীদ’। উর্দূ পড়া সম্ভব হলে উর্দূতে আর বাংলা অনুবাদ সহজবোধ্য হলে বাংলাতে সেই কিতাবগুলো অধ্যয়ন করা জরুরী।


এর দ্বারা আত্মশংশোধন হবে, নিজের মধ্যে আমলের আগ্রহ তৈরী হবে এবং নিজেদের নিসবতের মূল্যায়ন ও গুরুত্ব বুঝে আসবে যে, আল্লাহ তা‘আলা কত মহান বুযুর্গদের নিসবত এর সাথে আমাদেরকে সম্পৃক্ত করে রেখেছেন। 


দ্বিতীয় পর্যায়ে  

আমি যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো তা হলোঃ আমাদের আকাবির এ ব্যাপারে সদা সজাগ থাকতেন যে, খালেস দ্বীনের মধ্যে আক্বীদা ও আমলগত দিক দিয়ে বিদআত ও নব উদ্ভাবিত কোন বিষয়ের অনুপ্রবেশ কেউ যেন ঘটাতে না পারে, তাদের দৃষ্টিতে এ বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ববহ ছিল।


সাহাবা যুগ থেকে তাবেঈ যুগ, তাবেঈ যুগ থেকে তাবে তাবেঈ যুগ এভাবে ক্রমান্বয়ে এক স্তর থকে আরেক স্তর হয়ে যুগ যুগ ধরে যে সম্মিলিত ও সর্বসম্মত কর্ম পদ্ধতি আজ অবধি চলে এসেছে সেটাকেই আঁকড়ে ধরতে হবে। বিশেষত সাহাবায়ে কেরাম এর সাথে মুহাব্বাত রাখা এবং তাদের ব্যাপারে সঠিক আক্বীদা পোষণ করা, তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা, তাদের প্রত্যেককে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া ও বিভিন্ন মুআমালা ও মাসআলাগত বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম এর যে অবস্থান ছিল সেটা ধরে রাখাই আমাদের আকাবিরে দেওবন্দের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। 


#আমার সম্মানিত উস্তাদ হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন আহমাদ মুরাদাবাদী বুখারী শরীফের দরসে বলেনঃ পৃথিবীতে যত নতুন নতুন দলের আবির্ভাব ঘটছে, প্রত্যেকেরই একই দাবি যে, আমরাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, আমরা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল এর অনুসরণ করি এবং সে মতে তারা নিজ নিজ মতবাদ আয়াত-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত করার চেষ্টা করে থাকে, এহেন পরিস্থিতিতে আমাদের সম্মুখে এমন কোন মাপকাঠি থাকা উচিত, যার দ্বারা এ বিষয়টি নির্ণীত হয় যে, প্রত্যেকেই নিজ দাবির উপর কতটা সত্যবাদী।


অতঃপর আমার শাইখ বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন:


 من يعش منكم بعدى فسيرى اختلافا كثيرا .


অর্থ: আমার মৃত্যুর পরে তোমাদের মধ্য থেকে যারা বেঁচে থাকবে, তারা অনেক মতভেদ দেখতে পাবে, যথা এই বিংশ শতাব্দীতে অনেক নতুন দল ও নতুন মতবাদের আবির্ভাব ঘটেছে, তোমাদের জন্য এ পরিস্থিতিতে আমার দিকনির্দেশনা হলোঃ


  فعليكم بسنتى و سنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها و عضوا عليها بالنواجذ.


অর্থাৎঃ তখন তোমরা আমার সুন্নাত ও আমার কর্মপদ্ধতি এবং হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সঠিক পথের দিশারী খলীফাগণের কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করো এবং তা দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে  ধরো। (মুসনাদে আহমাদ হা.নং ১৭১৪৫)


অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: পূর্বের উম্মত ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল, আর আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, তাদের মধ্যে একদল ব্যতীত সকলেই জাহান্নামী। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেনঃ তারা কারা হবে? হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেনঃ ما أنا عليه وأصحابى অর্থাৎঃ যে পথের উপর আমি ও আমার সাহাবাগণ রয়েছে। সুতরাং ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতই হলো একমাত্র দল যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম এর আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত ও সাহাবায়ে কেরামকে হুজ্জাত তথা প্রমাণ ও সত্যের মাপকাঠি হিসেবে জানে, তাদের সিদ্ধান্তকে শরী‘আতের সিদ্ধান্ত মনে করে ও তাদের ইজমা তথা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তকে আল্লাহর হুকুম হিসেবে মনে করে।


এই ব্যাখ্যার পর হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন আহমাদ মুরাদাবাদী বলেনঃ যদি কোন দলের ব্যাপারে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চাও যে, তারা হকের উপর আছে কিনা? তাহলে এটা যাচাই করো যে ‘তারা সাহাবায়ে কেরামকে সত্যের মাপকাঠি মনে করে কিনা? সাহাবায়ে কেরাম এর ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী? তাহলে বুঝা যাবে যে তারা হক থেকে কতটুকু দূরে বা কাছে রয়েছে। 

 

এ মাপকাঠির ভিত্তিতে আমরা দেখতে পাই যে, হিজরী প্রথম শতাব্দীতে মুতাযেলা, খাওয়ারেজ, রাওয়াফেয এর আবির্ভাব ঘটে, তাদের সকলেই সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে বিরূপ ও জঘন্য আক্বীদা পোষণ করতো, তারা সাহাবায়ে কেরামকে গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট সাব্যস্ত করেছে, আবার কোনো কোনো সাহাবীকে কাফের পর্যন্ত সাব্যস্ত করেছে। (নাঊযুবিল্লাহ্) তারা কোনো সাহাবীকে মর্যাদা দিতে গিয়ে অতিরঞ্জিত করেছে, আবার কোনো সাহাবীকে দোষারোপ করে বাস্তব মর্যাদা থেকে অনেক নিচু স্তরে নামিয়ে দিয়েছে। এই শেষ যমানায়ও নতুন কিছু দলের আবির্ভাব ঘটেছে, আমি সুনির্দিষ্টভাবে দু’টি দলের কথা বলবো। 


# একটি দল হল ‘জামায়াতে ইসলামী’, আমাদের আকাবির এর সাথে তাদের কোন ধরনের সম্পর্ক ছিল না, যদিও আমাদের একদল বিজ্ঞ  আলেম, গ্রন্থ প্রণেতা ও ইসলাহী মুরব্বী মওদুদীর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, আল্লাহ তা‘আলা হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.কে উত্তম প্রতিদান দান করুন, তিনি সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও ঈমানী দূরদর্শিতার দ্বারা আচঁ করতে পারলেন যে, তারা সুন্দর লিখনি ও পোশাক-পরিচ্ছেদের অন্তরালে ঘাপটি মেরে ছিল। তাদের প্রথম প্রকাশনার মধ্যে লিখিত ছিল: ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যতীত কাউকেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে মনে করা যাবে না, বরং প্রত্যেককেই আল্লাহ প্রদত্ত মাপকাঠির উপর রাখতে হবে। কথা তো খুব সুন্দর। কিন্তু হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. প্রশ্ন উত্থাপন করে বসলেন যে, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে কী বলেন?, তারাও কি সাধারণ উম্মতের ন্যায়, তাদেরও কি কাজকর্মের সমালোচনা করা যাবে যেমনি ভাবে সাধারণ মানুষের বেলায় করা যায়? তারা উত্তরে বললোঃ হ্যাঁ। এ কারণেই  দেখা যায় যে, তারা প্রথম সারির সাহাবায়ে কেরাম যথা উমর রাযি. উসমান রাযি. আমর বিন আস রাযি. আয়েশা রাযি. মুআবিয়া রাযি. প্রমুখ বিখ্যাত সাহাবিকে নির্মমভাবে সমালোচনার পাত্র বানিয়েছিলো, তাদের কাছে এ বিষয়ে জবাবদিহিতা করা হলে তারা বললো যে, মানুষের অন্তরে উপরোক্ত সাহাবাদের সম্মানের ভূত এমনভাবে চেপে বসেছে যে, যতক্ষণ না তাদেরকে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করে ক্ষত বিক্ষত করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের অন্তর থেকে সেই ভূত অপসারণ করা সম্ভব হবে না। (নাঊযুবিল্লাহ) 


# আরেকটি দল হলোঃ ‘আহলুল হাদীস’, অর্থাৎ যারা শরীয়ত স্বীকৃত চারটি মূলনীতি থেকে দু’টি মূলনীতি ইজমা ও কিয়াসকে বর্জন করে আর বাকী দু’টি মূলনীতি কুরআন ও হাদীসের অনুসরণের দাবী করে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভাষ্য “ما أنا عليه وأصحابى  অর্থাৎঃ আমি ও আমার সাহাবাগণ যে পথে রয়েছেন তা তোমরা আঁকড়ে ধরো।” এর আলোকে উল্লেখিত চারটি বিষয়ই শরী‘আতের মূলনীতি হিসেবে সু-প্রমাণিত। এরাই আবার এমন সব মাসআলাতে দ্বিমত পোষণ করে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ থেকে ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে, যার সবক’টিই সাহাবায়ে কেরাম পর্যন্ত বিশুদ্ধ ও নিরবচ্ছিন্ন বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত।


উদাহরণ স্বরূপঃ 

# তারাবীহ এর নামায বিশ রাকা‘আত হওয়ার সিদ্ধান্ত হযরত উমর রাযি. এর যুগের সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম এর সম্মতি ও ঐক্যমতে গৃহীত হয়। 


# জুম‘আর নামাযের প্রথম আযান এর সিদ্ধান্ত হযরত উসমান রাযি. এর যুগের সকল সাহাবার ঐক্যমতে হয়।


# এক মজলিসে তিন তালাক দেওয়ার দ্বারা তিন তালাকই সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে হযরত উমর রাযি. এর যুগের সকল সাহাবায়ে কেরাম এর ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়। 


এ সব মাসআলা সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম এর সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কার্যকর হয়ে ক্রমাগতভাবে আমাদের নিকট পৌঁছেছে, এতে কারো কোনো দ্বিমত ছিল না, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন: تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ. অর্থাৎঃ সাহাবায়ে কেরাম এর কর্মপদ্ধতিকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরো। আমরা তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথার অনুসরণ করছি, আমাদের তো এই স্পর্ধা ও দুঃসাহস নেই যে, হযরত উমর রাযি. কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্তকে ‘বিদআতে উমরী’ বলবো, অথবা উসমান রাযি. কর্তৃক সম্মিলিত কোনো সিদ্ধান্তকে ‘বিদআতে উসমানী’ বলবো। এটাই হলো আমাদের আকাবির এর আদর্শ। 


সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে আমাদের করণীয় হলোঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে যে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে গিয়েছেন তাদের সেই মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সচেষ্ট থাকা ও তাদেরকে সেই স্তরেই সমাসীন রাখা, তাদের সিদ্ধান্ত, বর্ণনা ও সর্বসম্মত ঐক্যকে তদ্রুপভাবেই প্রমাণরূপে গ্রহণ করা, যেরূপে কুরআন ও সুন্নাহকে বাস্তব নির্দেশ ও মূলনীতি সাব্যস্ত করা হয়। এভাবেই আমাদের আকাবির সুন্নাতের অনুকরণের সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে থাকতেন।


# তদ্রুপভাবে তাযকিয়াহ ও আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা ও এটাকে বিদআত বলা মারাত্মক গোমরাহী। বস্তুত এটি হলো ইসলামের নির্দেশ, হাদীসে জিবরাঈলের সুস্পষ্ট ভাষ্য: জিবরাইল আ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে মানুষের আকৃতিতে এসে জিজ্ঞেস করলেনঃ أخبرنى عن الإيمان  আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করলেন, অতঃপর জিজ্ঞেস করলেনঃ أخبرنى عن الإحسان আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ان تعبدالله كأنك تراه، فإن لم تكن تراه فإنه يراك.  অর্থ: এমনভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছো, আর যদি তুমি তাঁকে দেখছো এটা ভাবতে না পারো, তাহলে মনে রাখবে যে, অবশ্যই তিনি তোমাকে দেখছেন। উম্মতকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ‘ঈমান’ ও ‘ইসলাম’ এর পর স্বতন্ত্রভাবে ‘ইহসান’ সম্পর্কেও প্রশ্নোত্তর করেছেন, এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ‘ইহসান’ একটি স্বতন্ত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:


فأحسنوا،إن الله يحب المحسنين. 


অর্থ:তোমরা ‘ইহসান’ করো, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ‘ইহসানকারীদের’কে পছন্দ করেন।


প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! এই ইহসানই হলো তাসাওউফ ও সুলূক তথা আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মবাদ, এটাই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস إنما الأعمال بالنيات. (অর্থ: যাবতীয় আমলের প্রতিদান নিয়তের উপরই নির্ভরশীল) এর মাধ্যমে, এটাই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী,


 أن تعبدالله كأنك تراه، فإن لم تكن تراه فإنه يراك. 


(অর্থ: এমনভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছো, আর যদি তুমি তাঁকে দেখছো এটা ভাবতে না পারো তাহলে মনে রাখবে যে, অবশ্যই তিনি তোমাকে দেখছেন।) এর মাধ্যমে, চরিত্র সংশোধনের জন্য এটারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, এ লক্ষ্যেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরাধামে আগমন করেছিলেন, আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

   هو الذى بعث فى الأميين رسولا منهم يتلو عليهم أياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة.  


অর্থ: তিনিই সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মাঝে রাসূল প্রেরণ করেছেন তাদের মধ্য থেকেই, যে তাদের কাছে আয়াত পাঠ করবে এবং তাদেরকে কুরআন ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দিবে এবং তাদের আত্মার সংশোধন করবে, এখানে আল্লাহ তা‘আলা কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দানের মাধ্যমে আত্মার সংশোধনের কথা বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: সে ব্যক্তি বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার রয়েছে। তিনি আরও ইরশাদ করেন: ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে বকরীর পালে ছেড়ে দিলে ততটা  ক্ষতিসাধন হয় না, অর্থ ও পদের লালসা দ্বারা ইসলামের যতটা ক্ষতিসাধন হয়। 


যদি পন্থা বলে দেওয়াটাই আত্মশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট হত, তাহলে সেটা ‘ويعلمهم الكتاب والحكمة অর্থাৎ; তাদেরকে কুরআন ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দিবে’ এর মধ্যেই এসে গেছে, তো ভিন্নভাবে ‘ويزكيهم অর্থাৎঃ এবং তাদের আত্মার সংশোধন করবে’ এটা সংযোজন করার কীইবা প্রয়োজন ছিলো? এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ‘তাযকিয়াহ’ তথা আত্মশুদ্ধির আমল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবিঈন, তাবে তাবিঈন সকলেই করেছেন, এবং ক্রমাগতভাবে এটি দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উম্মতের প্রতিটি স্তরে বিদ্যমান ছিল, এরই ধারাবাহিকতায় বিদআত ও বানোয়াট মুক্ত এই বিশুদ্ধ তাসাওউফ ও আত্মশুদ্ধি আমাদের আকাবির এর কর্মপন্থারই অংশ হিসেবে ছিল। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. ছিলেন এই আধ্যাত্মিক জগতে আমাদের সকলের শিরোমণি, আর কাসেম নানুতবী রহ., রশীদ আহমাদ গঙ্গুহী রহ., আশরাফ আলী থানবী রহ. ছিলেন সরাসরি তার অনুমতিপ্রাপ্ত খলীফা ও শিষ্য। থানবী মাদানী সাহারানপুরী সহ হেদায়াতের যাবতীয় সিলসিলা তার সাথে গিয়েই একীভূত হয়েছে।


বিশুদ্ধ তাওহীদ, রাসূলপ্রেম, সুন্নাতের অনুকরণ, সাহাবায়ে কেরাম এর সম্মান ও তাদের প্রতি সঠিক আক্বীদা পোষণ করা আকাবিরে দেওবন্দের আদর্শ, আর সমগ্র দ্বীনী ও কওমী মাদরাসাসমূহ এবং তৎসংশ্লিষ্ট বড় বড় মাশায়েখবৃন্দ যারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, তারা সকলেই উক্ত আদর্শের ধারক-বাহক, তারা একদিকে হাদীসের মসনদে শাইখুল হাদীসের আসনে অধিষ্ঠিত, অন্যদিকে খানকার মধ্যে মুরশিদ ও পথ প্রদর্শক এর ভূমিকায় অবতীর্ণ, একদিকে অসংখ্য ইলম পিপাসু তাদের থেকে উপকৃত হচ্ছেন, অপরদিকে সাধারণ মানুষ বাতিলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হচ্ছেন।


সুতরাং প্রিয় ভাইগণ! এই নিসবতকে মূল্যায়ন করুন, এর গুরুত্ব অনুধাবন করুন, এই দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকুন, সর্বদা এর সহযোগিতা করুন, উলামায়ে কেরামের দরবারে বেশি বেশি উপস্থিত হোন, তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখুন, তাদের কথাবার্তা ও যাবতীয় দিক নির্দেশনা মেনে চলার জন্য সদা সচেষ্ট থাকুন, তাহলে আশা করা যায় এই ফেৎনা-ফাসাদের যুগেও  এটাই হবে আমাদের হেদায়াতের পথ, এটাই হবে আমাদের মুক্তির পথ, ইনশাআল্লাহ্।


আপনাদের নিকট সংক্ষিপ্ত এই কথাগুলো পেশ করে এখানেই শেষ করছি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

Sunday, March 26, 2023

হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ ﷺ

 হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ ﷺ


এই লেখাটি সনাতন ধর্মের অনুসারী হিন্দু ভাই-বোনদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। হিন্দু ভাইয়েরা যেহেতু নিজের হাতের তৈরি মূর্তিকে নিজেই পূজা করে থাকেন, তাই মূল আলোচনার আগে জ্ঞানীদের জন্য মূর্তি পূজা সম্পর্কে অন্তরচক্ষু খুলে দেওয়ার মতো আল কুরআনের একটি উপমা তুলে ধরছিঃ


আল-কুরআনে আল্লাহ তাআলা মূর্তিপূজারীদেরকে মূর্তি পূজা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য খুব সুন্দর একটি উপমা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ‘হে মানবমন্ডলী! একটি উপমা দেওয়া হচ্ছে, মনোযোগসহকারে তা শ্রবণ কর; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো (মূর্তি) তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এই উদ্দেশ্যে তারা সবাই একত্রিত হলেও পারবে না; এবং মাছি যদি (তাদের সামনে রাখা প্রসাদ থেকে) কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়, এটাও তারা মাছির নিকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। পূজারী ও দেবতা কতই দুর্বল!’ (সূরা হজ্জ, আয়াত:৭৩)


আজ বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে ভাবতেই অবাক লাগে যে, সুস্থ জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কীভাবে নিজের হাতের তৈরি মূর্তিকে নিজেই পূজা করে! পূজা যদি করতেই হয়, তাহলে মূর্তির জন্য উচিত ছিলো তার তৈরিকারীর পূজা করা। কিন্তু সে পূজা করবে কি, সেতো তার খাদ্যের উপর থেকে একটা মাছিও তাড়াতে পারে না। সে এতই দুর্বল যে, কুকুর তার উপর পেশাব করে দিলেও সে কুকুরকে তাড়াতে পারে না। নিজে দাঁড়াতেও পারে না, বাঁশের খুঁটির জোরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এই যখন মূর্তির অবস্থা তখন কোন যুক্তিতে মূর্তির চেয়ে কোটিগুণ শক্তিশালী মানুষ মূর্তিকে পূজা করতে পারে?


যাই হোক মূল আলোচনা আসা যাক। আজ থেকে প্রায় বিশ-বাইশ বছর আগে ভারতে হিন্দি ভাষায় হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে গবেষণালব্ধ একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটি সমগ্র ভারতে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বইটির নাম “কল্কী অবতার” (যার অর্থ শেষ নবী)। বইটির লেখক একজন স্বনামধন্য হিন্দু পণ্ডিত, পণ্ডিত বেদ প্রকাশ উপাধ্যায়। তাঁর জন্ম এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিনি নিজেও হিন্দু। কিন্তু সত্য প্রকাশ করতে কার্পণ্য করেননি। এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির সংস্কৃত বিভাগের রিসার্চস্কলার, প্রখ্যাত গবেষক এবং স্বনামধন্য পণ্ডিত। ‘কল্কী অবতার’ শীর্ষক গ্রন্থে খ্যাতনামা আরও আটজন হিন্দু পণ্ডিতের সমর্থন রয়েছে। তাদের সত্যায়িত স্বাক্ষরও উক্ত গ্রন্থে রয়েছে।


পণ্ডিত বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় বলেন, হিন্দু ধর্মের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে যে পথপ্রদর্শক মহাপুরুষ (বিশ্বনবী) এর আগমনবার্তা “কল্কী অবতার” নামে লিপিবদ্ধ রয়েছে, তিনি মূলত আরবের মুহাম্মাদ সাহেবই। সেই প্রতিশ্রুত ‘কল্কী অবতার’ তিনি ব্যতীত আর অন্য কেউ নন। সুতরাং সারা বিশ্বের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উচিত, আর অপেক্ষা না করে, মহাপুরুষ মুহাম্মাদ সাহেবকে “কল্কী অবতার” (বিশ্বনবী) হিসেবে মেনে নেয়া। (যার দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে- তাঁর উপর ঈমান আনা এবং তাঁর আনীত ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করা।)


বইয়ের লেখক বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় সুস্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, হিন্দু ধর্মের অনুসারীগণ “কল্কী অবতার” এর অপেক্ষা করছেন, কিন্তু এটা এমন একটি অপেক্ষা, কিয়ামত পর্যন্ত যার যবনিকাপাত ঘটবার নয়। কারণ, তারা যে পবিত্র সত্ত্বার, যে মহাপুরুষের আগমনের অপেক্ষায় রয়েছেন, তাঁর তো আত্মপ্রকাশ ঘটে গেছে আজ হতে প্রায় চৌদ্দশত বৎসর পূর্বেই। তিনি এসে তাঁর মিশন বাস্তবায়িত করে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন।


পণ্ডিত বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় তাঁর দাবীর স্বপক্ষে হিন্দু ধর্মের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘বেদ’ ও ‘পুরাণ’ হতে দলীল পেশ করেছেন। তিনি লিখেছেন-


(ক) “পুরাণ” (হিন্দু ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ) এ লেখা আছে ‘ “কল্কী অবতার” এ জগতে ভগবানের (আল্লাহর) সর্বশেষ বার্তাবাহক (পয়গাম্বর) হবেন। তিনি সমগ্র জগত এবং বিশ্ব মানবতার পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রেরিত হবেন।’ এ বর্ণনার পর পন্ডিতজী লিখেছেন, এটা একমাত্র মুহাম্মাদ সাহেবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হচ্ছে। তিনিই সমগ্র জগত ও বিশ্ব মানবতার পথ প্রদর্শক।


(খ) হিন্দু ধর্ম-মতের একটি ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী “কল্কী অবতার” (বিশ্বনবী) একটি দ্বীপ সাদৃশ্য স্থানে জন্মগ্রহণ করবেন। হিন্দু ধর্মের কথিকা অনুযায়ী এ দ্বীপটি আরব দেশই, যা আরব উপদ্বীপ নামে খ্যাত।


(গ) হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে উল্লেখ আছে, “কল্কী অবতারের” পিতার নাম “বিষ্ণু ভগত” এবং মাতার নাম হবে “সুমানিব”। সংস্কৃতে “বিষ্ণু” এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- “আল্লাহ” এবং “ভগত” এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- “বান্দা”। সুতরাং “বিষ্ণু ভগতের” আরবী রূপ হবে “আবদুল্লাহ্” যার অর্থ হচ্ছে- “আল্লাহর বান্দা”। “সুমানিব” এর অভিধানিক অর্থ হচ্ছে- আমন বা শান্তি- যার আরবী রূপ হচ্ছে “আমিনা”। হযরত মুহাম্মাদ সাহেবের পিতার নাম আবদুল্লাহ্ এবং মাতার নাম আমিনাই ছিল।


(ঘ) হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় গ্রন্থ সমূহে উল্লেখ আছে- “কল্কী অবতার” এর প্রধান খাদ্য হবে খেজুর ও জয়তুনের তেল এবং তিনি সেখানকার লোকজনদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা আমানতদার ও সত্যবাদী হবেন। বলাবাহুল্য, এটাও মুহাম্মাদ সাহেবের উপর পরিপূর্ণরূপে প্রযোজ্য।


(ঙ) বেদগ্রন্থসমূহে লেখা আছে ‘কল্কী অবতার তাঁর এলাকার সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করবেন।’ এটাও পরিপূর্ণভাবে মুহাম্মাদ সাহেবের উপর প্রযোজ্য হয়।


(চ) ‘কল্কী অবতারকে ভগবান (আল্লাহ্) নিজস্ব বার্তাবাহক (ফেরেশতা) এর মাধ্যমে গুহার ভেতর শিক্ষা প্রদান করবেন।’ এটাও মুহাম্মাদ সাহেবের সাথেই খাটে। কারণ, হযরত মুহাম্মাদ সাহেবকে জিবরাইল ফেরেশতার মাধ্যমে হেরা গুহায় শিক্ষা দান করা হয়েছে।


(ছ) ভগবান (আল্লাহ্) এর পক্ষ হতে ‘কল্কী অবতারকে একটি দ্রুতগামী ঘোড়া প্রদান করা হবে- যার উপর সওয়ার হয়েই সমগ্র জগত এবং সপ্তম আকাশ পরিভ্রমণ করবেন।’ হযরত মুহাম্মাদ সাহেবের “বোরাকে” বসে মি‘রাজ গমনের দিকে উপরের বক্তব্যে সুস্পষ্ট ইংগিত রয়েছে।


(জ) ‘কল্কী অবতারকে ভগবান (আল্লাহ) আসমানী সাহায্য দানে ধন্য করবেন।’ বদর ও উহুদের যুদ্ধে মুহাম্মাদ সাহেবকে ফেরেশতার দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে, যা ছিল আসমানী সাহায্য।


(ঝ) সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হচ্ছে- ‘কল্কী অবতার চান্দ্র মাসের ১২ তারিখ জন্মগ্রহণ করবেন বলে হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।’ হযরত মুহাম্মাদ সাহেব চান্দ্র মাসের ১২ তারিখেই জন্ম গ্রহণ করেছেন।


(ঞ) ‘কল্কী অবতার ঘোড় সওয়ার ও তলোয়ার চালনায় হবেন সুদক্ষ।’ এ দলিলটি উল্লেখ করার পর পন্ডিতজী যা লিখেছেন- তা প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেন- বাস্তব সত্য হচ্ছে- ঐশীগ্রন্থ কুরআনে বর্ণিত, মুহাম্মাদ সাহেবই সেই “কল্কী অবতার” (বিশ্বনবী) যার আলোচনা আমাদের (হিন্দু) ধর্মগ্রন্থসমূহে বিদ্যমান রয়েছে।


উপর্যুক্ত দলীল ছাড়া আরো বহু সংখ্যক দলীল দ্বারা তিনি প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন যে, হিন্দু ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহে “কল্কী অবতার” (মহাপুরুষ) হিসেবে যার আগমনের কথা উল্লেখ রয়েছে, তিনি আরবের “মুহাম্মাদ সাহেব” ব্যতীত অন্য আর কেউ নন। সুতরাং যারা আমাদের পবিত্র গ্রন্থসমূহের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী “কল্কী অবতার” এর অপেক্ষা করছেন, তাঁদের চিন্তাধারা পরিবর্তন করা উচিত। (“সাপ্তাহিক আল-জমিয়ত” দিল্লী, ষষ্ঠ বর্ষ, ৩৫ তম সংখ্যা ২৭শে আগষ্ট, ১৯৯৩ ইং এর সৌজন্যে।)


সারকথা, পণ্ডিত বেদ প্রকাশ সাহেবের কথা দ্বারা একথা স্পষ্ট বুঝা গেল যে, হিন্দু ভাইয়েরা যদি আসলেই হিন্দু হয়ে থাকে এবং তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ মেনে থাকে, তাহলে তাদের জন্য জরুরী হলো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনীত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে যাওয়া। হিন্দু ভাইদের এ কথা জেনে রাখা উচিত যে, আল-কুরআনে সব মানুষের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্যকোনো ধর্ম পালন করে, তা কখনো তার থেকে গ্রহণ করা হবে না এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সূরা আল ইমরান, আয়াত : ৮৫)


তাই জ্ঞানী হিন্দু ভাই-বোনদের কাছে আমাদের আবেদন, আপনারা যদি পরকালের অশেষ-অসীম জীবনে শান্তি চান, যদি নরক থেকে বাঁচতে চান এবং স্বর্গে যেতে চান, তাহলে আপনাদের ধর্ম গ্রন্থে যে ‘কল্কী অবতারের’ কথা বলা হয়েছে (যিনি মূলত ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে মানুন এবং তাঁর আনীত ধর্ম ‘ইসলাম’ গ্রহণ করে ইহকাল ও পরকালের সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করুন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করুন। আমীন।

Friday, March 24, 2023

কাদিয়ানি মতবাদ

 কাদিয়ানি মতবাদ


এই দলের প্রতিষ্ঠাতা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ১৮৩৯/৪০ খ্রিস্টাব্দ পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা নিজ এলাকাতেই লাভ করেন। লেখা-পড়া সমাপ্ত করে পাঞ্জাবের এক অফিসে কেরানির চাকুরী গ্রহণ করেন। পূর্ব হতেই তার পরিবার ইংরেজদের তল্পীবাহক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। গোলাম আহমাদ প্রাথমিক পর্যায়ে নিজেকে একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হিসেবে প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইংরেজদের প্রকাশ্য দালালী ও নিজেকে মূলহাক, (যার অন্তরে দৈব বাণী অবতীর্ণ হয়) মুহাদ্দাস (আল্লাহ যার সাথে অন্তরে অন্তরে কথা বলেন), প্রতিশ্রুত ঈসা মসীহ, নিজেকে প্রথমে নবী এবং পরিশেষে ‘আমিই সর্বশেষ নবী’ ইত্যাদি অসংখ্য জঘন্য ভ্রান্ত আকীদার দাবী করে বসলে তার আসল চেহারা ফাঁস হয়ে যায় এবং সমস্ত হক্কানী আলেম উলামা তাকে মুরতাদ ফাতাওয়া দেন।


তার কিছু ভ্রান্ত আকীদা ও তার খন্ডন নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ


(১) আল্লাহ সম্পর্কে তার আকিদাঃ

মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী লিখেছেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি আমিই আল্লাহ’। (আয়েনায়ে কামালাতে মির্জা পৃ.৫৬৪,৫৬৫, কাদিয়ানী মাযহাব পৃ.৩২৮)


অথচ কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে ‘আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক, তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। (সূরা বাকারা.২৫৫)

 

সুতরাং ঘুমের মধ্যে আল্লাহ হওয়ার স্বপ্ন দেখাটা তার মিথ্যুক হওয়ারই প্রমাণ বহন করে। মির্জা কাদিয়ানীর বইতে আছে ‘আল্লাহ তাকে বলেছেন শুন!  হে আমার ছেলে’। (গোলাম আল বুশরা ১/৪৯, ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ পৃ.৩০৮)


অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। (সূরা ইখলাসঃ ৩) আরও দেখুন সূরা নিসাঃ১৭১, সূরা ইউনুসঃ৬৮)


হাদীসে কুদসীতে আছেঃ- আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘বনী আদম আমাকে মিথ্যারোপ করেছে, অথচ তার এরূপ করার কোনো অধিকার নেই এবং সে আমাকে গালি দিয়েছে, অথচ তার এরূপ করার কোনো অধিকার নেই। আর আমাকে মিথ্যারোপ করাটা এভাবে যে, সে বলে তিনি আমাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন সেভাবে কিছুতেই পুনরুত্থান করতে পারবেন না। আর আমাকে গালি দেওয়াটা এভাবে যে, সে বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন অথচ আমি অমুখাপেক্ষী, আমার সন্তান নেই এবং আমি কারও সন্তান নই এবং আমার কোনো সমকক্ষ নেই। (বুখারী হাদীস নং ৪৯৭৪, নাসাঈ হাদীস নং ২০৭৮)


(২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তার আকীদাঃ 

মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নিজ বইতে লিখেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী নন, বরং গোলাম আহমাদ সর্বশেষ নবী। (হাকীকাতুন নবুয়াত পৃ.৮২, তিরইয়াকুল কুলূব পৃ.৩৭৯, আদইয়ানে বাতেলা আওর সিরাতে মুতাকীম পৃ.১৩২)


অথচ কুরআনে এসেছে ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের কারো পিতা নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ’। সূরা আহযাবঃ ৪০


এক হাদীসে এসেছে, শীঘ্রই আমার উম্মতের মাঝে ৩০ জন মিথ্যুকের আবির্ভাব ঘটবে, তারা প্রত্যেকেই অমূলক দাবি করবে যে, সে আল্লাহর নবী, অথচ আমিই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোনো নবী নেই। (আবূ দাউদ ২/২২৮, তিরমিযী ২/৪৫, বুখারী হাদীস নং ৩৫৩৫, মুসলিম হাদীস নং ২২৮৬)


সে আরো লিখেছে, ‘গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অধিক মর্যাদাবান’ (হাকীকুতুন নাবুয়াত পৃ.২৭২, আরবাঈন পৃ.৩০৮, আদইয়ানে বাতেলা পৃ.১৩২, ইসলামী আকীদা পৃ. ৩০৮)


অথচ কুরআনে এসেছে, ‘সমস্ত নবীদের থেকে আল্লাহ তা‘আলা এ অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, তোমরা যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যামানা পাও তাহলে তোমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে’ (আল ইমরানঃ ৮১)


এই আয়াত দ্বারা বুঝা গেল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সকল নবীদের মাঝে শ্রেষ্ঠ আর গোলাম আহমাদ তো নবী নয় এমনকি একজন সাধারণ মুসলমানও নয় অতএব তার মর্যাদা একজন মুমিন থেকেও বহুগুন নিচে, তাহলে তার মর্যাদা নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বেশি হয় কীভাবে?


আর কুরআনে বিশের অধিক জায়গায় রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সম্বোধন করা হয়েছে কিন্তু মির্জা সাহেবের দাবি হলো এসব জায়গায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নয় বরং তাকে সম্বোধন করা হয়েছে। (দাফেউল বালা পৃ.১৩, ইজাযে আহমাদীঃ ১১/২৯১)


এমন মিথ্যাবাদীদের সম্পর্কে কুরআনে এসেছে, ‘তোমরা আল্লাহর সম্বন্ধে মিথ্যা বলতে ও তার নির্দেশ সম্বন্ধে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে, সে জন্য আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হবে (সূরা আনআমঃ৯৩)


কুরআন শরীফে নবীজীকে সম্বোধন করাটা মির্জা গোলাম আহমাদ নিজের দিকে সম্পৃক্ত করে কতবড় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে!


(৩) ঈসা আ. ও অন্যান্য নবীদের ব্যাপারে তার আকিদাঃ 

গোলাম আহমাদের বইতে আছে, ঈসা আ. এর তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। (ইজাযে আহমাদী পৃ.১৪, আদইয়ানে বাতেলা পৃ.১৩৩)


অথচ কুরআনে এসেছে ‘আল্লাহ অপেক্ষা অধিক সত্যবাদী আর কে হতে পারে? (সূরা নিসাঃ ৮৭) আর নবীগণ যা কিছু বলেন আল্লাহর হুকুমেই বলেন। অতএব নবীদের ভবিষ্যদ্বাণী কখনো মিথ্যা হতে পারে না। সুতরাং কাদিয়ানীর ঈসা আ. এর তিনটি ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যা হওয়ার দাবি করা পরোক্ষভাবে একথারই দাবি করা যে, আল্লাহই মিথ্যা বলেছেন (না‘উযুবিল্লাহ)


কাদিয়ানীর বইতে আছে, হয়রত ঈসা আ. মৃত্যু বরণ করেছেন, তিনি কিয়ামাতের পূর্বে আগমন করবেন না। (ইযালায়ে কুলাঁ ২/৩১১, আদইয়ানে বাতেলা পৃ.১৩৪)


অথচ কুরআনে এসেছে ‘কাফিররা বলে থাকেঃ আমরা আল্লাহর রাসূল মারইয়াম তনয় ঈসা মাসীহকে হত্যা করেছি, অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, কিন্তু তাদের বিভ্রম হয়েছিল। তারা নিশ্চয় এই সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল এ সম্বন্ধে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করে নাই বরং আল্লাহ তাকে আসমানে নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং আল্লাহ যবরদস্ত শক্তিমান ও হিকমাতওয়ালা’। (সূরা নিসাঃ১৫৭)


হাদীসে এসেছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, অচিরেই তোমাদের মধ্যে মারইয়াম তনয় ঈসা আ. আসবে ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ রূপে.... (বুখারী হাদীস নং ৩৪৪৮)


কাদিয়ানীর বইতে আছে, ‘মির্জা সাহেব বনী ইসরাইলের নবীদের চেয়ে উত্তম’ (দাফেউল বালা পৃ.২০)


অথচ সর্ব সম্মত আকীদা হলঃ কোন মুমিন চাই সে যত বড় বুযূর্গ হোক না কেন কোনো নবীর চেয়ে অধিক মর্যাদাবান হতে পারে না। (শরহে আকায়েদ পৃ.১৬১) তাহলে মির্জা সাহেব যিনি সাধারণ মুমিনের সমান নয়, তিনি কীভাবে বনী ইসরাঈলের নবীদের ঊর্ধ্বে মর্যাদা সম্পন্ন হতে পারেন? 


(৪) ফেরেশতা সম্পর্কে আকীদাঃ

মির্জার বইতে আছে ‘ফেরেশতা বলতে কিছু নেই’ (তাওযীহে মারাম পৃ. ২৯, আদইয়ানে বাতেলা পৃ. ১৩৩) অথচ কুরআনে এসেছে ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয় তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও..... (আল ইমরানঃ১৮, সূরা বাকারা.৩০,১৬১, সূরা নিসাঃ৯৭) ঈমানে মুফাস্সালের মধ্যে দ্বিতীয় নাম্বারে ফেরেশতাদের উপর ঈমান আনার ঘোষণা করা হয়েছে। তাছাড়া চারজন বড় বড় ফেরেশতার নাম কার অজানা? সুতরাং একমাত্র বেঈমান ব্যতীত অন্য কেউই ফেরেশতাদেরকে অস্বীকার করতে পারে না।


কাদিয়ানীর বইতে আছে ‘জিহাদের হুকুম রহিত হয়ে গেছে।’ (হাশিয়ায়ে আরবাঈন পৃ.১৫৪, আদইয়ানে বাতেলা পৃ.১৩৩) 


অথচ কুরআনে এসেছে ‘তোমরা তাদের (কাফিরদের) বিরুদ্ধে জিহাদ করতে থাকো যতক্ষণ না ফিৎনা (কুফুরী কর্মকান্ড) দূরীভূত না হয়..’ (সূরা আনফালঃ৩৯, আরো দেখুন, সূরা আন কাবূতঃ ৬৯, হুজুরাতঃ১৫, ফুরকানঃ৫২)


(৫) হাশর সম্বন্ধে কাদিয়ানীর বিশ্বাসঃ 

মির্জা বলেন, ‘মৃত্যুর পর হাশরের ময়দানে কেউ একত্র হবে না। বরং সরাসরি জান্নাত বা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (ইযালায়ে আহকামে কুলাঁ পৃ.১৪৪, আদইয়ানে বাতেলা পৃ.১৩৩) 


অথচ আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো যেদিন তাদের সকলকে একত্র করবো। মুশরিকদের বলবো, যাদেরকে তোমরা আমার শরীক মনে করতে তারা কোথায়? (সূরা আনআমঃ ২২, আরো দেখুন, কাহাফঃ৪৭, ফাতিহা আয়াতঃ ৩, এছাড়া বহু হাদীসে হাশরের ময়দানের আলোচনা আছে যেমন বুখারী শরীফ ১ম খন্ড বাবুস সুজূদ)


মির্জার আরো কিছু ভ্রান্ত আকিদাঃ

১. মির্জার বইতে আছে, ‘যে ব্যক্তি মির্জার নবুওয়াত মানে না সে জাহান্নামী কাফের’ (রবয়ীন পৃ.৪. আদইয়ানে বাতেলা পৃ. ১৩২) অথচ সমগ্র দুনিয়ার উলামায়ে কেরামের ফাতাওয়া হলো যে, যে ব্যক্তি মির্জাকে নবী মানবে সে কাফের।


২. মির্জা নিজে মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি করেছেন। (আয়েনায়ে কামালাতে ইসলাম পৃ. ৪২৩) (ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদঃ ৩২৬) অথচ সে ব্যক্তি হেদায়াত ও ঈমান বঞ্চিত এক বদ নসীব ও হাজারো মানুষকে গোমরাহ করণেওয়ালা।


৩. তারা উপরন্তু ২০ পারার মত কুরআন নাযিল হওয়ার দাবী করেছে। (হাকীকাতুল ওহী পৃ.৩৯১/ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদঃ৩২৭) অথচ নবী বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া কারো উপর আসমানী ওহী নাযিল হতে পারে না, হ্যাঁ, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক হয়তো তার উপর কোন হুকুম হয়েছিল সেটাকে তিনি ওহী মনে করেছেন। 


৪. তিনি নিজেকে হিন্দুদের শ্রী কৃষ্ণ অবতার হওয়ার দাবী করেছেন। (কাদিয়ানী মাযহাব পৃ.৪৩২/ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদঃ৩২৮) নাঊজুবিল্লাহ, এর দ্বারা তার কাফির হওয়া স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।


৫. তিনি নিজেকে যুলকারনাঈন হওয়ার হাস্যকর দাবি করেছেন। (বারাহীনে আহমদিয়া পৃ.৯৭/ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ পৃ.৩২৯) অথচ কুরআনে বর্ণিত জুলকারনাইন বহু পূর্বে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে ইন্তিকাল করেছেন। এছাড়াও তার আরও অসংখ্য ভ্রান্ত আক্বীদা রয়েছে। 


উল্লেখ্য যে, তিনি মিথ্যা নবী না হলে বেইজ্জতির মৃত্যু কামনা করতেন না এবং সেটি তার জীবনে বাস্তবায়িতও হতো না। এটাও তার মিথ্যুক হওয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ ছাড়া মুহাম্মাদী বেগম সহ বিভিন্ন ব্যাপারে তিনি অসংখ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যার সবগুলি পরবর্তীতে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ সত্য নবীদের কোন একটা ওয়াদা অঙ্গিকারও মিথ্যা প্রমাণিত হয় নাই। 


তার এসকল ভ্রান্ত আকীদার পরিপ্রেক্ষিতে সর্ব প্রথম ১৮৮৯ খৃ. লুধিয়ানার আলেমগণ তাকে কাফের বলে ফাতওয়া দেন। এর পর একে একে দারুল উলুম দেওবন্দ হতে ১৯৭৪ সালে, রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলনে ১৪৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের সংগঠনের পথ হতে তাকে এবং তার অনুসারীদেরকে সর্বসম্মতভাবে কাফের ঘোষণা করা হয়। এবং ১৯৮৮ সালে ও. আই. সি. এর উদ্যোগে সকল মুসলিম দেশের ধর্ম মন্ত্রীদের এক সম্মেলনে তাকে ও তার অনুসারীদেরকে কাফের ঘোষণা করার লিখিত প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়। সেমতে প্রায় সকল মুসলিম দেশেই তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। (ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ পৃ.৩৩২)