ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর অবদান
ইসলামী শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় যেমনঃ তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, মাগাযী ইত্যাদির শুরু ও সুচনা যদিও ইসলামের প্রারম্ভ থেকে হয়েছিল তবুও যত দিন পর্যন্ত সেগুলো একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রের মর্যাদা লাভ করেনি, তত দিন পর্যন্ত তার সঙ্গে কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম যুক্ত হয়নি। সে হিসেবে হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ফিকহশাস্ত্রের সঙ্গেও কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম যুক্ত হয়নি। হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ইমাম আবূ হানীফা নু’মান ইবনে সাবেত রহ.-এর সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিরলস চেষ্টা সাধনায় ফিকহশাস্ত্র পূর্ণতা লাভ করে এবং একটি সতন্ত্র বিদ্যায় রূপ নেয়। এজন্য ইমাম আবূ হানীফা রহ. ফিকহ আবিষ্কারক হিসেবে ভূষিত হন। ড. ফিলিপ হিট্টির ভাষায়ঃ
الاما م ابو حنيفة الذى وضع الاساس لاول مدارس شرع الاربع فى الاسلام.
অর্থঃ “আবূ হানীফা রহ. সেই ব্যক্তি, যিনি ইসলামে সর্বপ্রথম ফিকহ শরী‘আর ভিত্তি স্থাপন করেন।”
অর্থাৎ আবূ হানীফা রহ. সহীহ হাদীসের আলোকে ইস্তিমবাত, ও গবেষণার মাধ্যমে ফিকহে ইসলামীকে এমন পূর্ণতা ও সামগ্রিকতা দান করেন যে, তিনি ফিকহে ইসলামীর মূল ভিত্তি হিসেবে পরিগণিত হন। তিনি যেমন ঘটিত বিষয়ে ফাতাওয়া ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি সম্ভাব্য ও ঘটিতব্য মাসআলার ফাতাওয়া ভাণ্ডারও গড়ে তুলেছিলেন। ফলে তার ফাতাওয়া ভাণ্ডার বিশাল আকার ধারণ করেছিল। আবূল ফজল কিরমানী তার ইরশাদুল মারাম গ্রন্থে বলেন,-“আবূ হানীফা রহ.-এর মাসআলার সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো” আল্লামা আইনী রহ. তার ইনায়া গ্রন্থে বলেন, “আবূ হানীফা রহ.-এর মাসআলা বারো লাখ সত্তর হাজারের কিছু বেশি।” এর দ্বারা অনুমান করা যায় কী বিশাল ফিকহী ভাণ্ডারই না তিনি গড়ে তুলেছিলেন। আর এ কারণেই পরবর্তী সকল ফিকহ ও মাযহাব সৃষ্টি হয়েছে আবূ হানীফা রহ.-এর ফিকহকে পুঁজি করে।
উদাহরণতঃ শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম হলেন ইমাম শাফেয়ী রহ.। তিনি ফিকহ শিখেছেন ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর নিকট থেকে। আর ইমাম মুহাম্মাদ রহ. ছিলেন ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর প্রথম সারির শিষ্য। মালেকী মাযহাবের প্রবর্তক হলেন, ইমাম মালেক রহ.। তিনিও আবূ হানীফা রহ.-এর ফিকহ থেকে বেশ উপকৃত হয়েছেন। কাযী আবূল আব্বাস মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ধারাবাহিক সনদে আব্দুল আযীয আদ দারা ওয়ারদী হতে বর্ণনা করেন, ‘ইমাম মালেক রহ. ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর কিতাবসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করতেন এবং তা থেকে উপকৃত হতেন।’ অন্য এক বর্ণনায় আছে আবূ হানীফা রহ. মদীনা সফরকালে ইমাম মালেক রহ. তাঁর সাথে মসজিদে নববীতে মিলিত হতেন তারপর তারা উভয়ে ইশার নামাযের পর থেকে ফজরের নামায পর্যন্ত ইলমী আলোচনায় মশগুল থাকতেন। (ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনে আবিল আওয়াম-১০৩)
হাম্বলী মাযহাবের প্রবর্তক ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. ফিকহ ও হাদীস হাসিল করেছেন ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. থেকে। যাদের ফিকহের ভিত্তি ছিল ফিকহে আবূ হানীফা রহ.। হাফেয আবূল ফাতাহ সাইয়িদুন নাস ‘উয়ূনুল আসার’ গ্রন্থে লিখেন, “হযরত আব্দুল্লাহ আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. বলেন, আমার পিতা (আহমাদ ইবনে হাম্বল) ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মাদ রহ. থেকে তিন তাক পরিমাণ ইলমে শরী‘আহ লিপিবদ্ধ করেছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি সেগুলো অধ্যয়ন করতেন? আব্দুল্লাহ বললেন, মাঝে মাঝে অধ্যয়ন করতেন।” (আরো দেখুন বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ ১০/৩৪৭)
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, আবূ হানীফা রহ.-এর পর হতে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত মুহাদ্দিস ও ফকীহের আগমন ঘটেছে তারা সকলেই কোন না কোন মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং কোন না কোন ইমামের ফিকহের আলোকে জীবন যাপন করেছেন। সুতরাং পরবর্তী সকল মুহাদ্দিস ও ফকীহ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর ফিকহের কাছে ঋণী। এমন কি এ কথা বলাও অতিরঞ্জন হবে না যে, ইমাম সাহেব পরবর্তী গোটা মুসলিম যাহান তাঁর ও তাঁর ফিকহের কাছে চিরঋণী। ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর বিখ্যাত উক্তিটি লক্ষ করুন, মাযহাবের একজন মান্যবর হওয়া সত্ত্বেও তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন- الناس عيال ابي حنفة في الفقه
“ফিকহ বিষয়ে সকল মানুষ আবূ হানীফা রহ.-এর কাছে দায়বদ্ধ। (তারীখে বাগদাদ ১৩/৩৪৬; সিয়ারু আ’লামিন নবালা ৬/৪০৩, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪৫০)
তিনি আরও বলেছেন,
ما طالب احد الفقه الا كان عيالا على ابي حنفة
“যে কেউ ফিকহ অন্বেষণ করবে তাকে আবূ হনীফার কাছে দায়বদ্ধতা স্বীকার করতেই হবে। (ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনে আবিল আউয়াম ৭)
ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর ফিকহ আহোরণ ও সংকলন পদ্ধতিঃ
ইমাম আবূ হানীফা রহ. কীভাবে ফিকহ আহরণ করতেন তা স্বয়ং তার যবানীতেই শুনুন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সহীহ সনদে ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর যে
নীতিগুলো উল্লেখিত হয়েছে তার সারকথা এই-
১। মাসআলার সমাধান যখন কিতাবুল্লাহতে পাই তখন সেখান থেকেই সমাধান গ্রহণ করি।
২। সেখানে না পেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও সহীহ হাদীস থেকে গ্রহণ করি, যা নির্ভরযোগ্য হাদীস বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সহীহ হাদীস আমাদের শিরোধার্য, একে পরিত্যাগ করে অন্য কিছুর শরনাপন্ন হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
৩। এখানে যদি না পাই তাহলে সাহাবায়ে কেরামের সিদ্ধান্তগুলোর শরণাপন্ন হই।
৪। কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতু রাসূল্লিল্লাহ ও ইজমায়ে সাহাবার সামনে কিয়াস চলতে পারে না। তবে যে বিষয়ে সাহাবীদের একাধিক মত রয়েছে সেখানে ইজতিহাদের মাধ্যমে যে মত কুরআন-সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী বলে বোধ করি তা গ্রহণ করি।
৫। মাসআলার সমাধান এখানেও পাওয়া না গেলে ইজতিহাদের মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছে থাকি। তবে এ ক্ষেত্রেও তাবেয়ীগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হই না। (আল ইনতিকা ফী ফাযাইলিল আইম্মাতিছ ছালাছাতিল ফুকাহা, ইবনে আব্দিল বার ১২/২১৬-২৬৪, ফাযাইলু আবী হানীফা আবূল কাসিম ইবনু আবিল আউয়াম ২১-২৩, মাখতুত: আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহী, আবূ আব্দুল্লাহ আস সাইমারী (মৃত্যু ৪৩৬ হি.) পৃষ্ঠা : ১০-১৩, তারিখে বাগদাদ ১৩/৩৬৮, মানাকিবুল ইমাম আবূ হানীফা, মুয়াফফাক আল মক্কী ১/৭৪-১০)
ফিকহে মুতাওয়ারাস এর সংকলন এবং ফিকহে জাদীদে আহরণের যে নীতিমালা ইমাম সাহেবের নিজের ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে তা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের সকল ইমামের সর্বসম্মত নীতি। কোন ফিকহ তখনই ইসলামী ফিকহ হতে পারে যখন তা উপরোক্ত নীতিমালার ভিত্তিতে সংকলিত ও আহরিত হয়। ফিকহ সংকলন ও আহরণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত নীতিমালা অনুসরণে ইমাম সাহেব রহ. কতটুকু সফল হয়েছেন তা তার সমসাময়িক স্বীকৃত ইমামগণের বক্তব্য থেকে জানা যেতে পারে, যারা তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ইত্যাদি সকল ইসলামী শাস্ত্রের ইমাম ছিলেন, ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহ. (মৃত্যু-১৬১ হি.) বলেন, “আবূ হানীফা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইলম অন্বেষণ করেছেন। তিনি ছিলেন (দ্বীনের প্রহরী) দ্বীনের সীমানা রক্ষাকারী যেন আল্লাহর হারামকৃত কোন বিষয়কে হালাল মনে করা না হয়। কিংবা হালালের মতো তাতে লিপ্ত না হয়। যে হাদীসগুলো তার কাছে সহীহ সাব্যস্ত হতো অর্থাৎ যা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিগণের সনদে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তা গ্রহণ করতেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসল্লাম-এর কর্ম থেকে যেটি সর্বশেষ সেটি গ্রহণ করতেন আর কুফার আলেমগণকে যে সকল হাদীসের উপর প্রতিষ্ঠিত দেখেছেন সে সকল হাদীসও তিনি গ্রহণ করতেন। (কেননা এটাই ছিল সাহাবা যুগ থেকে চলমান আমল ও ধারা) (আল ইনতিকা, ইবনে আব্দিল বার পৃষ্ঠা: ২৬২) ফিকহে হানাফীর ভিত্তিই যখন হাদীস ও সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত তখন হাদীস ও সুন্নাহর সঙ্গে এর সম্পর্ক কতখানি মজবুত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্যই ইমাম ইবনুল মুবারক রহ. বলেছেন, ‘আবূ হনীফার ফিকহকে শুধু রায় বলো না। কেননা তা হলো হাদীসের তাফসীর।’ (ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনু আবিল আওয়াম-২৩)
সংকলন পদ্ধতি:
১২০ হিজরীতে হাম্মাদ রহ. এর ইন্তেকালের পর ইমাম আবূ হানীফা রহ. তার আসনে সমাসীন হলেন। এদিকে ইসলামী সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল। ইবাদাত ও মু’আমালাত সম্পর্কিত বিষয়াদিতে এত মাসআলা দেখা দিল যে, এর সমাধানে আইনের একটি সুবিন্যস্ত সংকলন ছাড়া কিছুতেই কাজ চলছিল না। তাই ইমাম আবূ হানীফা রহ. ফিকহ সংকলনের ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু এই মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিতে একদল দক্ষ, কর্মঠ ও অভিজ্ঞ আলেমের প্রয়োজন ছিল। সে মতে তিনি তার অগণিত ছাত্রদের মধ্য হতে বাছাই করে চল্লিশ জন দক্ষ ও কর্মঠ ছাত্র নিয়ে ফিকহ বোর্ড গঠন করেন।
ইমাম ত্বহাবী রহ. আসাদ ইবনে ফুরাত হতে অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেন, “আবূ হানীফা রহ. এর যে সকল ছাত্র ফিকহ সংকলনের কাজ আঞ্জাম দেন তাদের সংখ্যা (৪০) চল্লিশ জন।” এরা হলেন-
১. কাযী আবূ ইউসুফ
২. ইমাম মুহাম্মাদ
৩. ইমাম যুফার
৪. ওয়াকী ইবনুল জাররাহ
৫. ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া
৬. আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক
৭. দাউদ ইবনে নুসাইর
৮. হাফস ইবনে গিয়াস
৯. ইউসুফ ইবনে খালিদ
১০. আফিয়া ইবনে ইয়াযিদ
১১. হিব্বান ইবনে আলী
১২. মুনদিল ইবনে আলী
১৩. আলী ইবনে মুসহীর
১৪. কাসীম ইবনে মা’আন
১৫. আসাদ ইবনে আমর
১৬. ফযল ইবনে মুসা
১৭. আলী ইবনে যারইয়ান
১৮. হিশাম ইবনে ইউসুফ
১৯. ইয়াহইয়া ইবনে সাইদ আল কাত্তান
২০. শুআইব ইবনে ইসহাক
২১. হাফস ইবনে আব্দুর রহমান
২২. হাকাম ইবনে আব্দুল্লাহ
২৩. খালিদ ইবনে সুলাইমান
২৪. আঃ হামিদ ইবনে আব্দুর রহমান
২৫. আবূ কাসেম যাহহাক ইবনে মাখলাদ
২৬. মাক্কী ইবনে ইবরাহীম
২৭. হাম্মাদ ইবনে দালীল
২৮. আব্দুল্লাহ ইবনে ইদরীস
২৯. ফুজাইল ইবনে ইয়ায
৩০. হাইসাম ইবনে বাশীর
৩১. নূহ ইবনে দাররাহ
৩২. যুহাইর ইবনে মুআবিয়া
৩৩. শরীক ইবনে আব্দুল্লাহ
৩৪. নসর ইবনে আব্দুল কারীম
৩৫. মালিক ইবনে মা’ফুল
৩৬. জাবীর ইবনে খাযিম
৩৭. জারীর ইবনে আব্দুল হামীদ
৩৮. হাসান ইবনে যিয়াদ
৩৯. হাম্মাদ ইবনে আবী হানীফা
৪০. আবূ ইসমাতা নূহ ইবনে মারয়াম
সংকলন পদ্ধতি ছিল এরূপ, বোর্ডের সামনে কোন একটি মাসআলা পেশ করা হতো। সবাই এ ব্যাপারে এক মত না হলে অত্যন্ত স্বাধীনভাবে বিতর্ক শুরু হয়ে যেতো। এই বিতর্ক কখনও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আবার কখনও কয়েকদিন পর্যন্ত চলত। ইমাম আবূ হানীফা রহ. ধ্যান ও ধৈর্য্য সহকারে সকলের বক্তব্য শুনতেন। সবশেষে তিনি এমন পাণ্ডিত্যপূর্ণ ফায়সালা পেশ করেন যে, সকলেই তা মানতে বাধ্য হতো। আবার কখনও এরূপ হতো যে, ইমাম সাহেবের ফায়সালার পরও কেউ কেউ নিজ নিজ মতের উপর অটল থাকতেন। তখন ইমাম সাহেবের ফায়সালার পাশাপাশি ওই সব মতগুলোকেও লিপিবদ্ধ করে নেওয়া হতো। যতক্ষণ পর্যন্ত অধিকাংশ সদস্য কোন ব্যাপারে একমত না হতো ততক্ষন পর্যন্ত কোন মাসআলার ফায়সালা না করার বিধান ছিল। হাফেজ আবূল মাহাসেন রহ.- বলেন, এ সংকলনের বিন্যাস ছিল নিম্নরূপঃ
প্রথমে পবিত্রতার অধ্যায়, অতঃপর নামায ও রোযার অধ্যায়, তারপর ছিল ইবাদতের অন্যান্য অধ্যায়। অতঃপর মু’আমালাত ও লেনদেন এবং সর্বশেষে ছিল উত্তরাধিকারের অধ্যায়। পরবর্তীতে ইমাম মালেক রহ. ইমাম আবূ হানীফা রহ. সংকলিত ফিকহের এই বিন্যাস অনুযায়ী বিখ্যাত কিতাব মুয়াত্তা সংকলন করেন। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ. এর বর্ণনা অনুযায়ী এটা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। তিনি লিখেন, “যে বৈশিষ্ট্যে ইমাম আবূ হানীফা রহ. একক ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী তা হল, তিনিই সর্ব প্রথম শরী‘আতের ইলমকে সংকলিত করেছেন এবং বিষয় ভিত্তিক বিন্যাসে অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ বিন্যস্ত করেছেন। এরপর ইমাম মালেক রহ. মুয়াত্তা গ্রন্থে তাঁর অনুসরণ করেছেন এবং সুফিয়ান সাওরীও তার গ্রন্থে ঐ নীতি অনুসরণ করেছেন। এ ব্যাপারে কেউ আবূ হনীফা রহ.-এর অগ্রবর্তী হতে পারেন নি।’
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে কী পরিমাণ সতর্কতা ও পূর্ণতার সঙ্গে ফিকহ সংকলনের কাজটি আঞ্জাম পেয়েছিল। যা হোক ইমাম সাহেবের জীবদ্দশাতেই এ সংকলন প্রকাশিত হয়ে সকলের নিকট সমাদৃত হয়। এমনকি সে সময় তার সমকক্ষের দাবীদার ব্যক্তিবর্গও তাঁর এ সংকলন থেকে উপকৃত হন।
যায়েদা বলেন, আমি সুফিয়ান সাওরী রহ.-এর শিয়রে একটি কিতাব দেখতে পেলাম যে কিতাবটি তিনি পাঠ করছিলেন। অনুমতি নিয়ে আমি কিতাবটি দেখতে লাগলাম। দেখি সেটা আবূ হানীফা রহ.-এর ‘কিতাবুর রেহেন’ (বন্ধক সংক্রান্ত মাসআলার সংকলন) আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আবূ হনীফার কিতাব পাঠ করছেন? তিনি বললেন, আফসোস যদি তাঁর সবগুলো রচনাই আমার কাছে থাকতো।” (হযরত আবূ হানীফা রহ., শিবলী নোমানী পৃ: ১৫৩ বাংলা অনুদিত)
এ থেকে প্রতিয়মান হয় যে, ফিকহ সংলন ও গ্রন্থনায় ইমাম সাহেবের কী প্রভাব-বিস্তারক অবদান রয়েছে। তাঁর এই অনবদ্য ও অতুলনীয় অবদানের কথা আজকের কতিপয় আহলে হাদীস বন্ধু অস্বীকার করলেও ইমাম বুখারী রহ.-এর দাদা উস্তাদ ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে দাউদ কুরাইবী যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি বলেছেন, মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য হলো, নিজেদের নামাযে ইমাম আবূ হানীফার জন্য দু’আ করা। কেননা তিনি উম্মাহর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও ফিকহ সুরক্ষিত করে গিয়েছেন।